চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সন্তানের হাতে বই তুলে দিন, পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু

২০ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

নোবেল বিজয়ী রুশ কবি ইয়োসেফ ব্রদস্কির একটি বিখ্যাত উক্তি ঃ ‘বই পোড়ানোর চেয়ে গর্হিত অপরাধ অনেক আছে। সেগুলোর একটা হলো বই না পড়া।’

দিনকাল এমন হয়েছে, আজকের প্রজন্মের সন্তানেরা বই পড়ার প্রতি কেন জানি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এমনও হয়েছে, তারা পত্রিকাও পড়ে না। অথচ, একটা সময় ছিল, পরিবারের সকলে প্রতিযোগিতা দিয়ে পত্রিকা পড়তো। মেয়েরা মহিলা বিষয়ক, রান্না, সাজসজ্জা নিয়ে কি প্রকাশিত হলো, তা নিয়ে ব্যাপক কৌতুহল ছিল। আর ছেলেদের মধ্যে প্রবল আগ্রহের বিষয় ছিল খেলাধুলার পাতা, শিশুদের পাতা। এবং ‘শুভ মুক্তি’ শিরোনামে কোন কোন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। বয়স্করা পড়তেন সম্পাদকীয়, সাহিত্য বিষয়ক পাতা। দিনে দিনে এই আগ্রহ কমে গিয়ে শুধু একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে, এখন নানান প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, তারপরও এত পত্রিকা কেন বাজারে? হিসাবটা সহজ। বিজ্ঞাপন। পণ্যের প্রচার ও প্রসার বাড়াতে এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং প্রিন্ট মিডিয়ার বেশী অংশ জুড়ে থাকে বাহারি পণ্যের বিজ্ঞাপন। সুতরাং, যারা এর সাথে যুক্ত, তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে, কিভাবে ব্যবসা করা যায়। আগে যে সৃজনশীল পাঠক গড়ে তোলার যে উদ্দীপনা ছিল প্রকাশনা মালিকদের, তা এখন অনেকটা স্থিমিত হয়ে পড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে দেশে সপ্তাহে একদিন শুধু আনন্দের জন্য কিছু বই পড়ে। এমন ৯ বছর বয়সী ছেলেমেয়ের হার ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ছিল ৮১ শতাংশ। ২০১২ সালে সে হার কমে গিয়ে হয় ৭৬ শতাংশ। ১৩ বছর বয়সীদের মধ্যে ওই একই সময়ে এই হার নেমে আসে ৭০ শতাংশ থেকে ৫৩ শতাংশে। ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে এই হার নেমে আসে ৬৪ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে। অন্যদিকে যারা ক্লাসে বই ছাড়া আর কিছুই পড়ে না, অর্থাৎ যারা আনন্দের জন্য বই পড়ে না, তাদের হার ক্রমাগত বেড়েছে।

আমাদের দেশে অবশ্য এমন কোন জরীপের তথ্য নেই। কোন জরীপও হয়নি। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন চিত্রের সাথে আমাদের দেশের চিত্র মিলে যেতে পারে। এই কারণেই বলছি, আমাদের সন্তানেরা এখন আর আনন্দের জন্য বই পড়তে আগ্রহী নয়। তারা আনন্দের জন্য বেছে নিয়েছে ইন্টারনেটসহ তথ্যপ্রযুক্তি। মোবাইল/আই ফোনে তারা খেলাধুলা, ভিডিও গেম খেলে দিনের বেশির ভাগ সময়। বাকীটুকু সময় বরাদ্দ থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কোচিং-এর জন্য। এমন দৃশ্য আজ দেশের প্রতিটি ঘরেই পাবেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে বলি, আমার ঘরেও একই চিত্র। দুইটি পত্রিকা নিয়মিত রাখা হয়। বই ভর্তি আলমারি। কিন্তু, সন্তানের সেদিকে আগ্রহ নেই। নেশাগ্রস্তের হামলে পড়ে থাকে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলায়। এই দৃশ্য মনকে বড়ই পীড়া দেয়। এমন আরেকটি ভয়াবহ তথ্য পেলাম। চীন দেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ‘স্ক্রীন টাইম প্রলিফারেশন’ বা ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায় বেশি বেশি সময় কাটানো এমন বেড়েছে যে এর ফলে তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা শুরু হয়েছে। সচেতন মহলের কাছে বিনীত অনুরোধ থাকবে, নিজের সন্তানেরাও এমন হয়েছে কিনা, সেই দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। নতুবা, মেধা বিকাশের যে সময় তারা পার করছে, তা অচিরেই নিজের অজান্তে ধ্বংস করে ফেলবে। তখন, আর কিছুই করার থাকবে না।

পারিবারিক আবহ একটি বড় বিষয়। আগে একান্নবর্তী পরিবারে বই পড়ার অভ্যাস ছিল। মুরুব্বীদের দেখাদেখি ছোটজনেরাও বই পড়তো। কিন্তু, একান্নবর্তী পরিবারের সেই ধারা এখন অনেকটাই ম্লান। ফলে, দেখা গেছে বেশ কয়েক প্রজন্ম মেতে থাকে নিজের মধ্যে। স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ার চাপ আগেও ছিল। আমরাও তো সেই চাপ সামলে আনন্দের জন্য বই পড়েছি। কিন্তু, বর্তমানের শিক্ষার্থীরা পড়ছে না কেন? তাদের আগ্রহ কম কেন? এটি খুঁজে বের করতে হবে। একজন শিক্ষার্থী স্কুল থেকে এসেই ধাবিত হয় কোচিং সেন্টারে। ফিরে এসে আবার পড়া। তারপর ক্লান্ত হয়ে, একসময় মোবাইলে ভিডিও গেম খেলে। এইভাবেই দিন কাটছে। ফলে এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়, জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে যা কিছু পড়তে হয়, তার বাইরে আর কিছু পড়ার অবকাশ তারা পাবে না। আগ্রহও বোধ করবে না।

নিজের শহর চট্টগ্রামের কথাই বলি। শিশুসাহিত্য এখন আগের চাইতে অনেক সমৃদ্ধ। প্রতি বছরই শিশুতোষ কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস লিখছেন সাহিত্যিকেরা। কিন্তু, কতজন পড়ছে, তার কোন তথ্য আছে? নেই। বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হচ্ছে। বইমেলা হচ্ছে। কিন্তু, কতজন শিশু-কিশোর এই প্রকাশনা উৎসব বা বইমেলায় যাচ্ছে। বাবা-মা শখ করে সন্তানের জন্য বই কিনলেন। কিন্তু সেই সন্তানটি বইটি পড়েছে কি? হয়তো পড়েছে। নতুবা উল্টেপাল্টে-দেখে পরে পড়বো বলে রেখে দিয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের এই উদ্বেগ কিন্তু সুদূরপ্রসারী। তারা বলছেন, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির বেশি বেশি ব্যবহারের ফলে মানুষের দৈহিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য ও মস্তিকের ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ‘স্ক্রিন টাইম’ বাড়ার সমান্তরালে পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মস্তিস্কে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে- এমনই আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীরা।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ‘আনন্দের জন্য পড়া শুধুই বিনোদনের বিষয় নয়, আমাদের মস্তিস্কের বিদ্যমান ক্ষমতা রক্ষা করা এবং তা আরও বাড়ানোর সঙ্গেও খুব নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।’ তাই, মানসিক বিকাশ সাধনের জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই, তা সহজেই অনুমেয়। উন্নত বিশে^র চাইতে এশীয় অঞ্চলে পাঠকের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলে লেখাপড়ার আধিক্য। কিন্তু, কয়েক দশক ধরে তা ক্রমেই কমতির দিকে। তাই আমাদের ভাবিত করে তোলে সামগ্রিক বিষয়টি। আজকের যে শিশু জন্ম নিচ্ছে, সে মুখোমুখি হচ্ছে যন্ত্রের। তার কাছে সেটাই হয়ে উঠছে শিক্ষার বাহন। বিনোদনের মাধ্যম। সে কিন্তু জানতে পারছে না, আমাদের গৌরবমময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা। তার মধ্যে মেধা বিকাশের সৃজনশীল শক্তির হ্রাস পাবে ধীরে ধীরে। হয়তো বা কয়েক প্রজন্ম পর আমরা দেখতে পাবো, আমাদের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারীরা বই পড়তে গিয়ে বুঝতে পারছে না। তাদের শেখার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এমন অজানা আশংকায় মন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। হায়রে, কি করছি আমরা। এক্ষেত্রে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্র’র কর্মকান্ড আমাদের সকলের কাছে প্রেরণার উৎস। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে শিশুদের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব। আমরা এখন যদি সচেতন না হই, আমাদের আবহমান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশাল ঝুঁকির মধ্যে হাবুডুবু খাবে।

শিশু-কিশোরদের আবার কিভাবে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়? এমন প্রশ্ন জাগে মনে। আমরা তো শিশুদের বই নিয়ে প্রকাশনা উৎসব করছি। শিশুসাহিত্য উৎসবের আয়োজন করছি॥ কিন্তু, এখানে শিশুদের উপস্থিতি কেমন? মনে করুন, শিশুর জন্য বই লেখা হলো। কিন্তু সেই শিশুটির কাছে বইটি কতটুকু পছন্দ হয়েছে বা আদৌ পছন্দ হয়েছে কিনা তা জানার চেষ্টা করেছি কি? কেউ কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করে থাকবেন। যারা শিশু সাহিত্য রচনার সাথে জড়িত, তাঁদের কাছে বিনীত অনুরোধ, এই বিষয়টি একটু ভেবে দেখার। কারণ, যাদের জন্য লেখা, যাদের জন্য এই বই, আধুনিক যুগে এসে তারা পড়তে কতটুকু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। তাদের মনোজাগতিক বিষয়কে আমরা কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি। এই প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের ভাবনার সাথে পরিচিত হতে হবে। তাদের জানতে হবে, তারা কি চায়। কিসে তাদের আগ্রহ। কি ধরণের লেখায় মজা পায়। একটা সময় ছিল, বিভিন্ন রূপকথা, কল্পকাহিনী, ভূত-পেত্নীর গল্প জনপ্রিয় ছিল। এখন সময় পাল্টেছে। এই প্রজন্ম বিজ্ঞানের চরম বাস্তবতাকে নিয়ে বেড়ে উঠেছে। সুতরাং, তাদের জন্য সময়োপযোগী করে বই লিখতে হবে। সময় এসেছে, তাদের বোঝানো যে, যন্ত্র নয় – একমাত্র বই পড়ে মেধার উৎকর্ষ সাধন করতে হবে।

মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, “যে লোক পড়তে জানে কিন্তু বই পড়ে না, তার সঙ্গে যে লোক পড়তেই জানে না, তার কোন তফাত নেই।” আমরা হয়তো এমনটি চাই না। তাই, সকল অভিভাবক, শিক্ষক, প্রকাশকের কাছে বিনীত অনুরোধ শিশুদের হাতে বই তুলে দিন। তাকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করুন। অভ্যাসে পরিণত করুন। সৃজনশীল মেধা বিকাশে আপনার সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হোন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট