চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্বজন হারানো শ্মশান

সমকাল দর্পণ

ড. মাহফুজ পারভেজ

১২ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

‘আদিম হিং¯্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই/স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই’, মর্মে বহুল উচ্চারিত কথাগুলো বলেছিলেন তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৫ আগস্ট ১৯২৬ – ১৩ মে ১৯৪৭)। সাম্যবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী সুকান্ত প্রতিবাদ ও সংক্ষোভের ভাষা ব্যবহার করেছিলেন শোষক ও নির্যাতকদের বিরুদ্ধে। ‘বোধন’ নামের একটি বেশ বড় কবিতায় কথাগুলো আছে। কবির ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি সংযুক্ত রয়েছে।

বাংলা সাহিত্যের এই তরুণ কবি মাত্র ২১ বছর বেঁচে ছিলেন। জন্ম ও মৃত্যু পশ্চিম বাংলার কলকাতাতে হলেও সুকান্ত’র আদিভিটা বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া। অতএব, পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের জনজীবন ও সংস্কৃতিতে বিরাজমান প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের উত্তরাধিকার সুকান্তের মজ্জাগত।
সুকান্ত যদি আজকের প্রেক্ষাপটে বেঁচে থাকতেন, তাহলে শোষক ও নির্যাতকদের পাশাপাশি হন্তারকদের বিরুদ্ধেও ক্ষোভের দাবানল জ্বালাতেন। আমাদের আশেপাশে মনুষ্য-সৃষ্ট মৃত্যুকূপ দেখে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। কারণ, প্রতিনিয়ত চলমান শোষণ ও নির্যাতনের ধারায় আমাদের সমাজ ব্যবস্থা যে হারে ঠা-া মাথার হত্যা ও বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে চলেছে, তা কবি বা সংবেদনশীল মানুষ তো বটেই, যে কোনও সাধারণ মানুষও সহ্য করতে পারছেন না।

সদ্য সংঘটিত বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের হত্যাকা- ছাড়াও গাড়ি চাপায়, ব্যবসায়িক কারণে, হিংসা ও বিদ্বেষ বশে, মতপার্থক্যের জন্য, এমনকি তুচ্ছ ঘটনায় হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। বাইরের কেউ নয়, হত্যাকা- ঘটাচ্ছে আত্মীয়-প্রতিবেশী, আশেপাশের লোক, স্বজন, সহপাঠীরা। এই উন্মত্ততা ও নৃশংসতার ব্যাখ্যা করাও দুস্কর। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এহেন হিং¯্রতার বিশ্লেষণ ও প্রতিবিধান করা আজকে জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ধরনের আইন বহির্ভূত ও হটকারিতামূলক আচরণ, যা হত্যা ও নির্মমতার পরিচায়ক, তাকে নিন্দা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা।

সমাজে নানা কারণে মতপার্থক্য, ভিন্নমত, মতদ্বৈততা থাকতে পারে। সমাজে সবাই সব বিষয়ে একমত হবেন, এমনটি সম্ভব নয়। কিন্তু মতপার্থক্যের বা ভিন্নমতের কারণে একপক্ষ কর্তৃক আরেক পক্ষকে আক্রমণ বা হত্যা করা গণতান্ত্রিক সমাজে মোটেও কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে আইন ও বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। শাস্তি দেওয়ার সাংবিধানিক ক্ষমতা সেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের। অন্য কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিচার করার ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা নিজের/নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে না। নিলে তা হবে বেআইনি ও অপরাধমূলক।

বুয়েটের আবরার নামের ছেলেটি নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার আদ্যোপান্ত ঘটনা সিসিটিভি ফুটেজ, মিডিয়া রিপোর্ট ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যের মাধ্যমে সকলেই অবগত হয়েছেন। ঘাতকরা, যারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নির্দয়ভাবে ভারী ভোঁতা বস্তু দিয়ে পিটিয়ে পলে পলে তাকে মৃত্যুযন্ত্রণা উপলব্ধি করিয়ে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে করে শেষে ছেলেটিকে মৃত্যুর হাতে তুলে দিয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেলো, মৃত ছেলেটিকে ধরাধরি করে হলের করিডোর দিয়ে ৩ জন ছাত্র নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অনুসরণ করছে আরও ৫/৬ জন ছাত্র। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, সকলেই নির্লিপ্ত এবং পরিতাপহীন।
দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, এরা সবাই দেশের সেরা ছাত্র। এত বর্বরতা এদের মাঝে, তা ভাবাই যায়না ! এত ঠা-া মাথার খুনি এরা কী করে হল? শিউরে উঠলাম এদের চেহারা দেখে। যে ছেলেটিকে তারা খুন করল তার সাথে তাদের দৃশ্যত কোন শত্রুতা নেই। তাহলে তারা তাকে কেন এমনভাবে মারল? এ কোন সমাজে বসবাস করছি আমরা? খুন করার লাইসেন্স তো তাদের কেউ দেয়নি? ফলে খতিয়ে দেখতে হবে সবকিছু। সামাজিক যে ব্যাধি ছাত্রদের হায়েনা বানায়, সেই ব্যাধি দূর করতে হবে এখনই, যাতে আর কোনও সম্ভাবনাময় ছাত্র ভবিষ্যত অকালেই ঝরে না যায়, আর এরকম সেরা ছাত্ররা যেন ঠা-া মাথার খুনিতে পরিণত না হয় আর কখনোই।

এ কথাও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের আইনানুগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বেআইনি ভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনাগুলো বিপজ্জনক। এতে সমাজ বিপন্ন ও রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয় এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়। ফলে এসব ন্যাক্কারজনক কাজ যারা করে, তারা রাষ্ট্র, সমাজ, আইন ও বিচার ব্যবস্থার জন্য বিরাট হুমকি স্বরূপ।
বিভিন্ন সময়ে চেনা ও অচেনা অপশক্তি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। স্বাধীনতার পর পর গণপিটুনি, হাইজ্যাক, দখল ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছিল। বেআইনি কাজের দৌরাত্মে তখন সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরাট ক্ষতি হয়। আবার তেমন অরাজকতার প্রকাশ যারা ঘটাচ্ছে, তারা সমাজ, মানুষ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বন্ধু নয়। তারা মানবিক নয়। এদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকার ও নাগরিক সমাজের জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিষয়টি কতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে তা মূলধারা ও সামাজিক মিডিয়ায় জনপ্রতিক্রিয়াগুলো দেখলেই অনুধাবণ করা যায়। প্রবল জনমত ও জনঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে এ নৃশংস ঘটনায়। বলা বাহুল্য, বুয়েটের নৃশংস ঘটনায় সংবেদনশীল মানুষ মাত্রেই বিচলিত হয়েছেন। তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে মানবিক মানুষের মনে। একজন কবি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘আবরারের নির্যাতিত ছবি দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। হয়তো দম আটকে মারা যাবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার পায়ে ধরছি, এই নৃশংসতার বিচার করুন।’

বাংলাদেশ যেভাবে স্বজন হারানো শ্মশানে পরিণত হচ্ছে উগ্র ও আইন অমান্যকারীদের দ্বারা, তা দ্রুত প্রতিহত করতে হবে। সবাই মিলেই করতে হবে।
ি ড. মাহফুজ পারভেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট