চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পারিবারিক সহিংসতা রোধে সুফিবাদচর্চা

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

৪ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:২০ পূর্বাহ্ণ

হিংসার বশবর্তী হয়ে একে অপরের প্রতি যে আচরণ করে তাই সহিংস আচরণ বা সহিংসতা। পরিবারের এক সদস্য কর্তৃক অপর সদস্য সহিংস আচরণ তথা অত্যাচার, অবিচার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া মানে পারিবারিক সহিংসতা। এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বরং বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের অপ্রতিরোধ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা সমাজের ন্যায় প্রাচ্যের দেশগুলোতেও এ সমস্যা বিরাজ করছে এবং দিন দিন বেড়ে চলেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক অস্থিরতা, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়া, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, দাম্পত্য কলহ, অর্থলিপ্সা, মাদকাসক্তি, অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক, পরকীয়া, অত্যাধিক চাহিদা, যশ-খ্যাতি অর্জনের অসমপ্রতিযোগিতা ইত্যাদি পারিবারিক সহিংসতার কারণ। তাঁরা এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য নৈতিক শিক্ষাকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত নৈতিক শিক্ষালয়ে অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক যখন নারীনির্যাতন, শিশুনির্যাতন, বলাৎকার ইত্যাদির খবর আসে তখন প্রশ্ন জাগে কোন ধরণের নৈতিক শিক্ষা পারিবারিক সহিংসতার রোধে সফল হতে পারে, নারী ও শিশুদেরকে সুরক্ষা দিতে পারে এবং কলহ, বিবেদ, বিদ্বেষ, সহিংসতার স্থলে মমতাপূর্ণ, শ্রদ্ধাভরা পরিবার ও সমাজ উপহার দিতে পারে। তদুত্তরে সুফিবাদ বিষয়ক জ্ঞানার্জন, সুফিবাদী জীবনাদর্শের অনুসরণ এবং সুফিবাদী চরিত্রচর্চার মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতা রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। বিশ্বশান্তির জন্য ইতিমধ্যে চর্চিত ব্যর্থ মতবাদের বিকল্প হিসেবে যেমন সুফিবাদ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে তেমনি রাষ্ট্রীয় আইনের ব্যর্থতার ওপর দাঁড়িয়ে পারিবারিক সহিংসতা রোধ করে সুখী পরিবার গঠনেও সুফিবাদ যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে- এমন মতও তাঁরা দিয়েছেন। ২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ওলামা সম্মেলনে মত প্রকাশ করা হয় যে, বিশ্বমানবতার সংকট সমাধানে সূুফিবাদ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে (আব্দুল মান্নান চৌধুরী, তাসাউফ, পৃ. ১৬)।

সুফিবাদে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ ও অনুশীলনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। পরস্পর সমাঝোতার জন্য যে সহিষ্ণুতা প্রয়োজন- সুফিবাদে তাঁর গুরুত্ব অত্যাধিক। সুফিবাদের অপর নাম মনকে কলুষমুক্ত রাখা। পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, “মানুষের শরীরে এমন একটি অংশ আছে, যা বিশুদ্ধ হলে তার পুরো শরীর বিশুদ্ধ হয়ে যায় আর সেটি নষ্ট হলে পুরো শরীরই নষ্ট হয়ে যায়, নিশ্চয় তা হলো তার মন” (ছহিহ বুখারি, ১/২০)। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় সফল হয়েছে সেই ব্যক্তি, যে নিজের আত্মাকে কলুষমুক্ত করেছে” (সুরা আ‘লা : ১৪)।

সমাজবিজ্ঞানীরা পারিবারিক সহিংসতার যেসব কারণ চিহ্নিত করেছেন সেগুলো সুফিবাদে জঘন্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। সুফিগণ রিপুকে দমন করেন কঠোরভাবে। তাঁরা লোভ-লালসার ঊর্ধে থাকেন। প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ পোষণ, প্রতিশোধপরায়ণতা তাঁদের নিকট খুবই ঘৃণিত বিষয়। মাদক, অবৈধ যৌনচার, পরকীয়া ইত্যাদি অপকর্ম ও গর্হিত কাজের চিন্তাও তাঁরা করতে পারেন না। মানুষকে তো নয়, যে কোন জীবকে কষ্ট দেয়াকেও তাঁরা বড় পাপ মনে করেন। কারো মনে আঘাত দেয়াকে পবিত্র কাবা ঘর ভেঙ্গে ফেলার চেয়ে মারাত্মক গুনাহ মনে করেন। অবৈধ ও অতিউপার্জন, জোরপূর্বক কিছু আদায়, নিজের মত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া, পেশিশক্তি দিয়ে কোন সমস্যা সমাধান করাকে তাঁরা মোটেই পছন্দ করেন না। পার্থিব বিষয়ে অযৌক্তি প্রতিযোগিতা, অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া, খ্যাতি অর্জন ইত্যাদিকে তাঁরা তুচ্চ জ্ঞান করেন। মানুষের নিকট কিছু পাওয়ার আশা তাঁদের নেই। পক্ষান্তরে মানবতার সেবা করা, মানুষকে ভালবেসে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন, অন্যের চেয়ে নিজেকে ছোট ও পাপী মনে করা, বড়জনের প্রতি শ্রদ্ধা আর ছোটকে ¯েœহ করা, প্রত্যেকের প্রাপ্য ও হক যথাযথভাবে আদায় করা, ভুল হলে ক্ষমা চাওয়া, সবার প্রতি বিন¤্র আচরণ ইত্যাদি সুফিচরিত্রের অপরিহার্য অংশ। অতএব যেসব কারণে পারিবারিক সহিংসতা দেখা যায় সেগুলোর স্থান সুফিবাদে নেই। বরং যেসব চরিত্রের কারণে মানুষে মানুষে প্রীতি, ভালবাসা, মায়া-মমতা, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলোই সুফিগণ চর্চা করেন। কারণ, সুফিবাদের মূল ভিত্তি পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ। রাসুলুল্লাহ (দ.)-এর জীবনাদর্শের প্রত্যেকটি দিককে অকৃত্রিমভাবে গ্রহণ করা এবং তাঁর চরিত্রের আলোকে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁকে পাওয়ার সাধনা, তাঁর অস্তিত্বকে অনুভব করার প্রচেষ্টা এবং তাঁর মিলনের চেষ্টাই সুফিগণের মূল উদ্দেশ্য। ¯্রষ্টা আর সৃষ্টি উভয়ের সন্তুষ্টি অর্জনও তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য। রাসুলুল্লাহ (দ.) পরিবারের দায়িত্ব ও তাদের প্রতি সদাচরণকে অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন তাঁর পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নিকট অতিপ্রিয়। তিনি তাঁর পরিবারকে ভালবাসতেন, সময় দিতেন, পারিবারিক কাজে সাহায্য করতেন। হযরত খাদিজা, আয়েশা, হযরত ফাতিমা, হযরত আলি, হযরত হাসান ও হুসাইন (র.)- এর প্রতি তাঁর ভালবাসা বিষয়ক অসংখ্য হাদিস পাওয়া যায়। পরিবারের কারো প্রতি তিনি কঠিন আচরণ করেছেন মর্মে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তিনি নিজেই বলেছেন, “সেই ব্যক্তিই উত্তম যে তার পরিবারের নিকট প্রিয়। আর আমি আমার পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়” (ছহিহ ইবন হিব্বান, হাদিস নং-৪১৮৬)। হযরত আনাস র. দশ বছর তাঁর খেদমতে ছিলেন। কিন্তু কোনদিন তিনি হযরত আনাস র.-এর সামনে “উফ” শব্দ উচ্চারণ করেননি। কোন কাজ করলে কেন করলে, আর না করলে কেন করলে না- এমন কোন জবাবদিহিতার মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়নি (ছহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৫১)।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহর অনুগ্রহেই আপনি আপনার অনুসারীদের সাথে সহানুভূতিশীল আচরণ করছেন। যদি আপনি তাদের প্রতি রূঢ় ও কাঠোর হতেন তবে তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত (সুরা আলি ইমরান: ১৫৯)। তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে প্রাচ্যবিদ চার্লেজ মিলস-ঈযধৎষবং গরষষং (১৭৮৮-১৮২৬) বলেন, “তাঁর আত্মা করুণার আধার ছিল। নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজ করতে গিয়ে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বের মধ্যে তিনি কোন ব্যাঘাত করতেন না। তাঁর স্বভাব-চরিত্রের সরলতা, যা প্রকৃতগতভাবে প্রাপ্ত, সেটা কোন ছোট কাজ করতে লজ্জাবোধ করত না। তাঁর কথা বলার ভঙ্গিমা লৌকিকতামুক্ত ছিল। যখন তিনি আরব জাহানের অধিপতি তখনও তিনি তাঁর জুতা এবং পশমী মোটা কাপড় নিজ হাতে সেলাই করতেন। নিজে বকরীর দুধ দোহন করতেন। ঘরের বিছানা ঝাড়– দিতেন এবং চুলা জ্বালাতেন। খেজুর ও পানি ছিল তাঁর সাধারণ খাবার। মধু ও দুধ তাঁর উন্নত খাবার। সফর অবস্থায় খাদেমদেরকে নিজের খাবারে শরিক করতেন। মৃত্যুকালে সহায়-সম্বলহীনতা তাঁর সারা জীবনের উপদেশাবলীকে সত্যায়ন করে” (হিস্টোরি অব মুহামেডানিজম, পৃ. ৩৪)। মারগুলিত বলেন, “কিন্তু তিনি তাঁর স্ত্রীদেরকে এখতিয়ার দিয়েছেন যে, তাঁরা যদি পার্থিব সম্পদকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁকে ছেড়ে যেতে চান, তাহলে তাঁর কোন আপত্তি নেই। হযরত আয়েশা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন আর অন্যরা তাঁর অনুসরণ করেছেন” (মুহাম্মদ এন্ড রাইজ অব ইসলাম, পৃ. ৪৪৮)। এডওয়ার্ড গিবন (১৭৩৭-১৭৯৪ খ্রি.) বলেন, “মুহাম্মদের ভাল স্বভাব ছিল যে, তিনি বাদশাহি ও বিলাসী জীবন যাপন করতেন না। আল্লাহর নবি হয়েও তিনি দৈনন্দিন ঘরোয়া কাজ করতে লজ্জাবোধ করতেন না। তিনি চুলা জ্বালাতেন, বিছানা পরিষ্কার করতেন, বকরীর দুধ দোহন করতেন, নিজের হাতে জুতা মেরামত করতেন এবং নিজের কাপড় সেলাই করতেন। সন্ন্যাসী পদ্ধতির জীবন বর্জন করা সত্ত্বেও তিনি গর্ব বা অহংকারমুক্ত একজন সাধারণ আরব সৈনিকের খাবার গ্রহণ করতেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে তিনি তাঁর সাহাবিগণকে গ্রাম্যরীতিতে আতিথেয়তা করতেন। কিন্তু পারিবারিক জীবন ছিল এমন যে, সপ্তাহব্যাপী তাঁর চুলায় আগুন জ্বলত না। মদের নিষেধাজ্ঞা তাঁর পরিবার থেকে সুনিশ্চিত করা হয়েছিল। তিনি উপবাসের জীবন যাপন করতেন। ক্ষিধা নিবারণ করতেন রুটি দিয়ে। দুধ ও মধু ছিল তাঁর উন্নত খাবার। কিন্তু দৈনন্দিন খাবার ছিল খেজুর আর পানি (দি ডিক্লাইন এন্ড ফল অব দ্যা রোমান এম্পাইয়ার, ২/৬৯৪)।

সুফিগণ আল্লাহর নবি (দ.)-এর চরিত্রে চরিত্রবান। তাঁর সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসারী। যিনি যত বড় সুফি তিনি তত বেশি সেই গুণাবলী অর্জন ও চর্চা করেছেন। ইমাম আল-কিনানী (রহ.) বলেন, “যিনি চরিত্রে তোমার চেয়ে এগিয়ে যাবে তিনি তাসাউফেও তোমার চেয়ে এগিয়ে যাবে” (আল-কুশাইরী, রিসালাহ, পৃ. ২৪০)। তাই সুফির পথ ও মতে পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহিংসতা বড় পাপ। সুফি পরিবার মানে সহিংসতামুক্ত পরিবার। এ প্রসঙ্গে হযরত আবুল হাসান খারকানী (রহ.) এর ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। তিনি তাঁর স্ত্রী থেকে ভাল ব্যবহার পেতেন না। কিন্তু তিনি কোনদিন স্ত্রীর প্রতি সহিংস আচরণ করেননি; বরং কষ্ট সহ্য করে জীবন কাটিয়েছেন। স্ত্রীর প্রতি কোন সহিংস আচরণ না করার কারণে আল্লাহ তায়ালা পাঁচটি বাঘ তাঁর অনুগত করে দিয়েছেন, যেগুলো পাহাড় থেকে কাঠ বহন করাসহ বিভিন্ন কাজে তাঁকে সাহায্য করত।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খতিব, চবক আ/এ জামে মসজিদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট