চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের নারীশ্রমিকের মানবেতর জীবন

পাহাড়ী ভট্টাচার্য

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

বরি শালের ফাতেমা আক্তার দেশে অসুস্থ্য স্বামীর চিকিৎসাব্যয় নির্বাহ ও সন্তানদের ভরণ পোষণের জন্য সৌদি আরব গিয়েছিলেন গৃহ-কর্মীর কাজ নিয়ে। ঢাকার আরেক নারী কবিতা খানমও জীবন-নির্বাহের তাগিদে, পরিবারের ভরণপোষণের জন্যই অনন্যোপায় হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন ভালোভাবে বাঁচবেন, কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছল্যের মুখ দেখবেন-বলে। দু’জনেরই স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে! সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন, প্রতিশ্রুতির চাইতে অনেক কম মজুরী, নামমাত্র খাবার, অতিরিক্ত কাজের চাপ, নিয়মিত মারধর, যৌন-নিগ্রহ একপর্যায়ে কোনক্রমে পালিয়ে নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে আশ্রয় নেয়া এবং পরিশেষে বাংলাদেশে প্রত্যার্বতন তাদের।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য বিশেষত: সৌদি আরব থেকে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী নারী গৃহশ্রমিক ফেরত এসেছে দেশে। নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীদের সহায়তাদানকারী ‘ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি’-র পরিসংখ্যান মতে, বিভিন্ন সময়ে কাজের সূত্রে সৌদি আরব যাওয়া নারীদের মধ্যে গত ৮ মাসে প্রায় ৮০০ নারীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালের এ সময়ে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৫৩ জন।

এ মুহূর্তে দেশে ফেরার জন্য দূতাবাসের সেফ হোমে অপেক্ষারত রয়েছেন অনেক বাংলাদেশী নারী-গৃহকর্মী। এসব ঘটনাবলি, নিঃসন্দেহে, যথেষ্ট গুরুত্ববহ ও উদ্বেগের। বাংলাদেশের অসহায়, অস্বচ্ছল, ভাগ্যবিড়ম্বিত বিভিন্ন বয়সী নারীদের মোটা বেতন, ভাল থাকা-খাওয়া, আর্থিক প্রণোদনা ও অন্যবিধ সুযোগ-সুবিধাদির লোভ দেখিয়ে, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার কথা বলে পরিবার সদস্য, পরিচিতজন কিংবা ম্যানপাওয়ার ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত মধ্যস্বত্বভোগী দালালেরা স্থানীয় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে মূলত গৃহকর্মী বা গৃহশ্রমিক হিসাবে সারাবছর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। এ সামগ্রিক প্রক্রিয়াটির প্রতিটি ধাপই নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

জর্ডান, সৌদি আরব, ইউনাইটেড আরব আমিরাত, ওমান, লেবানন, কাতারসহ বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৪৩টি দেশে দক্ষ-অদক্ষ গৃহশ্রমিক হিসাবে নারীরা গেলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসন-প্রত্যাশীর কাক্সিক্ষত ও চূড়ান্ত গন্তব্য হয় প্রধানত সৌদি আরব। কারণ, গৃহশ্রমিকদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করার পাশাপাশি, উন্নততর জীবন ও আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাদি বেশি পরিমাণে দেয়ার অঙ্গীকার করে থাকে দেশটি। যদিও এতদিন র্জডান ছিল মূলত প্রধান ‘ফিমেল ডমিস্টিক ওয়ার্কার রিক্রুটিং কান্ট্রি’ তথা বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারীগৃহকর্মী নিয়োগদানকারী দেশ।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জায়গাটি দখলে নিয়েছে সৌদি আরব। যা হোক, প্রত্যক্ষ তিক্ত অভিজ্ঞতার, সৌদি-প্রত্যাগত নারীদের বিভিষীকাময় দিনলিপির কথা, ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকা-মিডিয়া-চ্যানেলের বদৌলতে আমরা কম-বেশি সকলেই অবগত।
প্রায় এক দশক আগে, ড্যান চার্চ এইড বাংলদেশ নামক একটি সংস্থার সহযোগিতায় গবেষক সামিহা হুদা অভিবাসী ও স্বদেশ প্রত্যাগত নারী গৃহশ্রমিকদের ওপর ‘সিচ্যুয়েশন অব মাইগ্রেন্ট ওম্যান ওর্য়াকার্স অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণা-কর্ম পরিচালনা করেন।

তাঁর গবেষণাপত্রটিতে তিনি দেখিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে গৃহকর্মে নিযুক্ত ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার নারীদের তুলনায় আমাদের দেশের নারীশ্রমিকেরা অধিকতর দক্ষ, দায়িত্বশীল এবং আন্তরিক হওয়া সত্ত্বেও অনেক কম মজুরী ও সুযোগ-সুবিধাদি পায়। সেই সাথে, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের ভাগ্যে জোটে মালিক-কন্ট্রাকটর-নিয়োগকর্তা-মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে প্রতিনিয়ত অশোভন ও অশালীন আচরণ, নানাবিধ শারিরীক নির্যাতন-নিপীড়ন, যৌন-নিগ্রহ ও খুনের ঘটনা।

অনিরাপদ ও অনুপযুক্ত কর্মপরিবেশ, অতিরিক্ত কাজের চাপ, অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত মজুরী, অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় উপযুক্ত চিকিৎসা ও ক্ষতিপুরণ না পাওয়া, ছুটি-বিশ্রাম-বিনোদন-আহারের অপর্যাপ্ততা, বিদেশের মাটিতে পৌঁছানোর পর পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়া, প্রতারণার শিকার হওয়া ইত্যাদি তো আছেই। নানাবিধ বঞ্চনা-নির্যাতনের বলি হয়ে জুন ২০১৯ পর্যন্ত ৬০ জন নারীশ্রমিক বিদেশের মাটিতে মারা গেছেন। আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া নারীশ্রমিকদের নির্ভরযোগ্য কোন পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। সামিহা হুদা বাংলাদেশের ১৬টি জেলায় সরেজমিন অনুসন্ধান, সাক্ষাৎকার, তথ্য-জরিপ কার্যক্রম, সংগৃহিত তথ্যাদির যাচাই-বাছাই শেষে দেখিয়েছেন বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের অভিবাসন প্রক্রিয়াকে ঘিরে বিদ্যমান বাস্তবতার এক করুণ ও উদ্বেগজনক চিত্র। তাঁর গবেষণাপত্র সূত্রেই জানা গেল, গত এক দশকে বৃহত্তর ঢাকা বিভাগ থেকে সর্বাধিক সংখ্যক নারী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের সন্ধানে গেছেন, চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলো থেকে নারীদের শ্রম-অভিবাসনের হার তুলনামূলকভাবে কম।

ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এম্পøয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং (বিএমইটি)-র পরিসংখ্যান মতে ২০১৫ সালে ১,০৩,৭১৮ জন, ২০১৬ সালে ১,১৮,০০০ জন, ২০১৭ সালে ১,২১,৯২৫ জন এবং ২০১৮ সালে ৭৩,৭১৩ জন নারী শ্রমিক মূলত গৃহ-কর্মী হিসাবে বিদেশে গিয়েছেন। ‘গ্লোবাল এলায়েন্স এগেইন্সট ট্রাফিকিং উইমেন’ নামক একটি সংস্থার মতে, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজে যাওয়া নারীশ্রমিকদের সিংহভাগই অতিরিক্ত কাজের চাপ, অনভ্যস্ত বিজাতীয় সামাজিক রীতি, প্রতিকূল পারিপাশির্^ক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ-এর মুখোমুখি হবার পাশাপাশি নানাবিধ শারীরিক-আর্থিক-মানসিক নিপীড়নেরও শিকার হয়। নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করলেও ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ একটি চুক্তিতে উপনীত হয়ে সেখানে গৃহকর্মী পাঠাতে শুরু করে।
মোটা দাগে, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিয়োগকর্তা/প্রতিষ্ঠানের আচরণ কখনোই নারী কিংবা শ্রমিকবান্ধব নয়। মূলত ইঙ্গ-মার্কিন অক্ষ-বলয়ের আশীর্বাদ ও মদদপুষ্ট, পুঁজিবাদী পশ্চিমা স্বার্থের বিশ্বস্ত পাহারাদার রাষ্ট্র সৌদি আরব। দু’একটি ব্যাতিক্রম বাদে, বলা চলে, পেট্রোডলারের দাপটে-ভোগে-বিলাসে মত্ত সৌদি নিয়োগকর্তা-মালিক-কর্তৃপক্ষ সেদেশে কর্মরত ৩য় বিশ্বের বিদেশী শ্রমিকদের সাথে সামগ্রিক আচরণে কখনোই সহনশীল, ইতিবাচক ছিল না। ফলে, প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ, সম্পাদিত চুিক্তর র্শতভঙ্গ, আর্থিক অন্যায়-অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, শ্রমিকের সাথে দুর্বিনীত, পাশবিক আচরণ আজ সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রাত্যাহিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

আমাদের দেশের শ্রম অভিবাসন-প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট মধ্যস্বত্ত্বভোগী, রিক্রুটিং এজেন্সি, সরকারের বৈদেশীক কর্মসংস্থান কিংবা পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দৃঢ় মনোভাব, ভূমিকা ও ইফেক্টিভ বার্গেনিং অ্যান্ড নেগোশিয়েটিং ক্যাপাবিলিটির অভাবেও অনেক সময় শ্রমিককে হতে হয় শোষণ-বঞ্চনার শিকার। নারীশ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা আরো প্রকট।
শ্রম-অভিবাসন মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশই শুধু নয়, তা বিশ্বব্যাপী একটি চর্চিত, চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পরিম-লে আধুনিক পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে যদি আমাদের দক্ষ-অদক্ষ শ্রমজীবী মানুষ দেশে এবং দেশের বাইরে কর্মহীন থাকে, যদি আমাদের জনশক্তি রফতানি বন্ধ হয়। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে শুরু করে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন পরবর্তী আজকের পরিবার ও সমাজজীবনে বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। বিদেশের মাটিতে আমাদের নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা কাজ করবে অনিবার্যভাবে মৈত্রী, সমতা ও মর্যাদার ভিত্তিতে।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের কল্যাণ ও সুরক্ষায় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি’ প্রণীত হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিল্স-এর উদ্যোগে, জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন ও মানবাধিকার সংগঠনসমূহের সমন্বয়ে ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’ গঠনের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, সেমিনার, ক্যাম্পেইন-এডভোকেসি কার্যক্রমের ফলশ্রুতি হল এ নীতিমালা।

বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের আজ শ্রম আইনের অধীনে আনার প্রচেষ্টা চলছে। অথচ, মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে কর্মরত বাংলাদেশী নারীগৃহকর্মীদের জন্য সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা, আন্তর্জাতিক রীতি ও কনভেনশন, সিডও সনদ, আইএলও-র ১৮৯ নং শোভন কাজের ধারাসহ মৌলিক নাগরিক কিংবা ন্যূনতম মানবিক অধিকারসমূহ কার্যকর করা যাচ্ছে না। তাই আজ বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে এ ইস্যুতে নিতে হবে সময়োচিত, কৌশলী ও কার্যকর পদক্ষেপ। বিদেশের মাটিতে প্রাণপাত করা আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের স্বার্থেই এটি আজকের প্রত্যাশা ।

লেখক : রাজনৈতিক কর্মী, একটি বেসরকারী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট