চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

মো. মোরশেদুল আলম

১৭ মার্চ, ২০২৩ | ১:৫৫ অপরাহ্ণ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহাকালের মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী আজ। ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস আপন তাগিদেই তার ‘মহানায়ক’-এর উদ্ভব ঘটায়, আর সেই ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ই হয়ে ওঠেন ইতিহাস রচনার প্রধান কারিগর-স্থপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের একজন বড় মাপের নেতা ও রাজনীতির একজন মহানায়কই শুধু ছিলেন না; তিনি ছিলেন ইতিহাসেরও মহানায়ক। বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়কদের পাশে আপন যোগ্যতায় নিজের অবস্থান নিয়ে যেতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব গুণাবলি দিয়ে। শুধু সফল রাষ্ট্রনায়কই নয়, তিনি একটি স্বাধীন জাতির সামনে একমাত্র প্রতীক হয়ে জ্বলজ্বল করে আমৃত্যু জ্বলেছেন এবং বাঙালি জাতি যতদিন এই পৃথিবীতে থাকবে ততদিন তিনি আপন মহিমায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

বাল্যকাল ও কৈশোর জীবন থেকেই যে সংগ্রামের শুরু হয়, তা আর থেমে থাকেনি বরং কালক্রমে তা আরো বিস্তৃত হয়ে সমগ্র বাঙালি জাতির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এক মহৎ প্রচ্ছদপট এঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার ইতিহাসের মহামানব হয়ে ওঠেন। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আমরা বাঙালিরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত হব। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন।

সেই থেকে ধাপে ধাপে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যখন যে এলাকায় যেতেন সে এলাকার সংগঠক বা নেতা-কর্মীকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতেন। নিজে কর্মী থেকে সংগঠক হয়েছেন, সংগঠক থেকে হয়েছেন নেতা, নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং পরিশেষে আন্তর্জাতিক নেতা। আর এটি সম্ভব হয়েছে অসংখ্য কর্মীকে তিনি নেতা বানিয়েছেন, অসংখ্য নেতাকে স্থানীয় পর্যায় থেকে তুলে এনে জাতীয় নেতায় উন্নীত করেছিলেন। ফলে সমগ্র বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজো বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ ও লালন করেই টিকে আছে।

পাকিস্তান সরকারের প্রতিটি আঘাত বঙ্গবন্ধুর জন্য বীরমাল্যস্বরূপ ভূষণ হয়ে ওঠে। ক্রমান্বয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা অসামন্য উঁচু স্তরে পৌঁছে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একক ও অবিসংবাদিত নেতা। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু অভূতপূর্ব বিজয় ছিনিয়ে আনেন। নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয় ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে। শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। যদি কেউ এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার জন্য জাগ্রত জাতির ঐক্যের প্রতীক। স্বাধীনতার মহান স্থপতি। জাতির পিতা। জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচি। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দি মুজিব ছিলেন, মুক্ত মুজিবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। শত বছরের বাংলার ইতিহাসে কত মনীষী, কত নেতা এসেছেনÑতাঁদের কর্মকা-ে বাঙালিদের অগ্রবর্তিত করেছেন। করেছেন দীপ্তিময় ও অনন্য। রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, লালন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুভাষ বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, প্রফুল্ল চন্দ্র, মেঘনাদ সাহা, জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বসু, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম প্রমুখ বরেণ্য মনীষীদের পাশ কাটিয়ে বঙ্গবন্ধু এক যাদুকরি বৈশিষ্ট্যে চিরভাস্বর হয়ে রয়েছেন। শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে রাজনীতির কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। দেশভাগের আগে থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক বাঙালির বুকের মধ্যে সাহসের যে প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছিলেন তার বদৌলতে স্বাধীন বাংলার মাটিতে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা, যে পতাকায় দেখা যায় জাতির পিতার প্রতিচ্ছবি।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন পরশ পাথরের মতো। তাঁর পুণ্য হস্তের ছোঁয়ায় গোটা বাঙালি জাতি অচেতন থেকে সচেতন হয়েছিল, নিরস্ত্র থেকে সশস্ত্র হয়েছিল। যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তাঁর হৃদয়ের ভালোবাসা ছিল অপরিসীম।

১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামি সংস্থার সম্মেলনে তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের লায়ালপুরের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন কারা কর্মকর্তা ছিলেন হাবিব আলী। ওই সম্মেলনে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোফায়েল আহমদের। হাবিব আলী বলেছিলেন, “বন্দী থাকা অবস্থায়, বিচারকার্য চলাকালীন অবস্থায় তোমাদের নেতার মুখ থেকে আমরা একটি শব্দও বের করতে পারিনি। তোমরা মহা সৌভাগ্যবান এই কারণে যে, তোমরা এমন একজন নেতা পেয়েছ যিনি সত্যিই মহান।

কারাগারের পাশে তাঁর জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল এবং আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আত্মপক্ষ সমর্থন বা অন্তিম কোনো ইচ্ছা আেিছ কি না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে এই নাটকের যখন যবনিকাপাত ঘটবে, আমার অন্তিম ইচ্ছা, আমার লাশটা যেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে পাঠানো হয়।” বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে এতসব দুর্লভ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল বলেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু একজন আকাশছোঁয়া স্বপ্নচারী, একজন রাজনৈতিক কবি, একজন অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন বাংলার হৃৎস্পন্দন। বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁর সমগ্র জীবনের কর্মের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে এই অমর, অবিনশ্বর চেতনা। তিন যুগের অধিক সময়জুড়ে প্রবাহিত এই মহান মানুষটির বিপুল কর্মময় রাজনৈতিক জীবনে যে আচরণ চর্চিত হয়েছিল, তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে হিরন্ময় দ্যুতি এবং মানবিক সব আচরণ বৈশিষ্ট্য। যা সত্যিই দুর্লভ। বঙ্গবন্ধুর চেতনা অমর, অবিনশ্বরÑএর মৃত্যু নেই। ইতিহাসের চাহিদা অনুযায়ী যে ব্যক্তি জনগণকে জাগিয়ে তুলতে পারেন এবং জাগ্রত জনগণের গণবাণীকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করতে পারেনÑতিনিই হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের মহানায়ক।

ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “তারা তাদের সর্বস্ব দিয়েছিল কেননা তারা জানত আমি তাদের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ছিলাম। আমি তাদের মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। আমি মৃত্যুর পরোয়া করিনি। আমি তাদের সুখী দেখতে চেয়েছিলাম। আমার মানুষের ভালোবাসা ও আন্তরিকতার কথা ভাবলে আবেগ তাড়িত হয়ে যাই।” মার্কিন কূটনৈতিক আর্চার ব্ল্যাড লিখেছেন, “শেখ মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ‘মুকুটহীন সম্রাট’। তবে এই মুকুটহীন সম্রাট হয়ে ওঠার পেছনে ইতিহাসটা গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর যে ভাবমূর্তি তা একদিনের নয়। বিভিন্ন পরিবর্তন, রাজনৈতিক গতিপ্রবাহ এবং বলা চলে তথাকথিত পাকিস্তানের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা, দৃঢ়চিত্ততাÑসর্বোপরি তাঁর জনগণের সামনে নিজের আদর্শ ও নীতি এবং বক্তব্যের রাজনৈতিক দর্শনের অকপটতা। ঊনিশ’শ আটচল্লিশের জিন্নাহর ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তির প্রতিবাদের ভেতর দিয়েই তাঁর বাংলা প্রীতির সম্যক পরিচয় ঘটেছিল এদেশের মানুষের কাছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেনÑএদেশের মানুষ আমার জীবনের জন্য অজস্র রক্তপাত করেছে। আমি তাদের স্বার্থের প্রশ্নে বেঈমানী করতে পারি না। দরকার পড়লে আমি আমার দেশের মানুষের রক্তের ঋণ নিজের রক্ত দিয়ে পরিশোধ করব। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। কোন কুটিল চক্রান্তের আশ্রয় নেননি। দীর্ঘ নয় মাস কারান্তরালে ধুঁকেছেন। কিন্তু আপসকরেননি।”বস্তুত বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নবনির্মাণ, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়তাবাদ, বাঙালির নিজস্ব জাতি-রাষ্ট্র এবং আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল অদ্বিতীয় ও সর্বব্যাপ্ত।বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দূত-স্বাধীনতা ও শান্তির প্রতীক। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবিস্মরণীয় ভূমিকার জন্য তিনি সমগ্রবিশ্বে সমাদৃত। লেখক :  শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্বিবিদ্যালয়

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট