চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন

মোহাম্মদ আবু তাহের

৩০ জুন, ২০১৯ | ১:০৫ পূর্বাহ্ণ

বেকারত্ব দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়। এটি দেশের বিরাজমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির একটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। দেশের সামাজিক সংকটে বিষয়টি যে কারণে দৃশ্যমান হচ্ছে তা হচ্ছে সর্বস্তরের জনগণের নিকট যুগোপযোগী শিক্ষার আলো প্রবেশে বাঁধা।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং উক্ত সমস্যা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে সার্বিক কল্যাণের পথ প্রশস্ত করা এবং অগ্রগতি ও উন্নয়নের গতিধারাকে অব্যাহত রাখা। এই শিক্ষার আলো যতোবেশী সর্বত্র ও সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়বে ততোই একই সাথে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থবিরতা হ্রাস পাবে এবং সর্বব্যাপী উন্নয়ন বেগবান হবে। কিন্তু যে সমস্যার কারণে উন্নয়ন প্রাণ খুঁজে পাচ্ছে না, তাহলো জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান আধিক্য, দারিদ্র্য, সীমাহীন দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, একটি গোষ্ঠীর হাছে বিত্তের পাহাড়। এ সমস্যাগুলো এতোই প্রকট এবং একে অপরের সহযোগী বিধায় একটি সমস্যা অন্য আরেকটি সমস্যাকে উৎসাহিত করে। দেশ যদি নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত থাকে, তবে বেকারত্ব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ভেসে উঠে। সুতরাং দেশের মূল সমস্যাসমূহ দূর করতে না পারলে বিচ্ছিন্নভাবে কোন সমস্যা নিরসন সহজসাধ্য হবে না।
এখনো পর্যন্ত দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর প্রচুর শিক্ষিত যুবক ডিগ্রী অর্জন করে। শিক্ষাজীবন শেষ করার পরেও কর্মক্ষেত্রে তাদের অর্জিত শিক্ষা দেশের প্রয়োজন পূরণ করে না। যাতে শিক্ষিত হয়েও বেকার জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্যোগে বিভিন্ন কৃষি, শিল্প ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কিছু সময়ের জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমাদের পোশাকশিল্প মোট রপ্তানীর ৭৬% ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বৃহৎ ও মাঝারি আকারের পোশাকশিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের তৈরি পোশাক উৎপাদনের পাশাপাশি পৃথকভাবে প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করলে বহু শিক্ষিত যুবক তাদের প্রশিক্ষণ গ্রহনের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জিন করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দক্ষ কর্মীর চাহিদা পূরণ করতে পারে।
শুধুমাত্র চাকুরীর উপর নির্ভরশীল না হয়ে আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচীর মাধ্যমে শিক্ষিত বেকার যুবকেরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক পেশা, যথা মৎস চাষ, ফুল চাষ, সবজি উৎপাদন, পোলট্রি ও ডেইরী ফার্ম, আসবাবপত্র তৈরি, পোশাক শিল্পের এক্সেসরিজ প্রস্তুত ও সরবরাহকারী এবং অন্যান্য যাবতীয় শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ করে প্রভৃতি অর্থনৈতিক কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ করে জীবিকার সংস্থান করতে পারে। তবে আশার কথা, ইতিমধ্যে বহু শিক্ষিত বেকার যুবক এসব পেশায় নিয়োজিত থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছে এবং অনেকেই সফল হয়েছে। এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সরকারী ও বেসরকারি ব্যাংকসমূহ শহর ও গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে অর্থায়নের জন্য অনেক ব্যাংকই এসএমই কেন্দ্র স্থাপন করছে। এসব কেন্দ্রে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষেত্রবিশেষে বিনা জামানতে উদ্যোগী, সৎ, পরিশ্রমী ও প্রতিভাবান উদ্যোক্তাদেরকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। এসব ক্ষেত্রে আদায়ের হার ও সন্তোষজনক। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ জনপদে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের উন্নতির প্রয়াসে সকল সকল বাণিজ্যিক ব্যাংককে এ খাতে অর্থায়নের জন্য এসএমই সেন্টার খোলা বাধ্যতামূলক করেছে। অন্যদিকে দেশের লক্ষ লক্ষ নাগরিক বিদেশে কর্মরত থেকে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, এর মধ্যে অধিকাংশ অদক্ষ। বিদেশে বিভিন্ন দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা নিরূপণ করে দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করলে বৈদেশিক মুদ্রা বা রেমিটেন্সের হারের পরিমাণ ও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের চাকুরীর মেয়াদ ও চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। এতে করে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের চাপ কমবে।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সমস্যার চাপের পাশাপাশি সীমিত অর্থনৈতিক পরিসর এবং নৈতিক অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে বেকার সমস্যা ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছে। আমাদের শিক্ষিত বেকার যুবকদের যেকোন পেশা গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে কোন পেশাই ঘৃণার নয়। বরং নৈতিকতা বিবর্জিত উপার্জনই অপমানের, ঘৃণার ও ধিক্কারের। বর্তমান সময়ে তাই পরিত্যাগ করতে হবে।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা অতি সম্প্রতি কর্মসংস্থান সম্পর্কে এক বাস্তবধর্মী বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, কোন কাজ যে ছোট কাজ নয় এ কথাটাও মানুষকে বোঝাতে হবে। লিখাপড়া শিখলেই আমি ধান কাটতে পারবো না এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকেরা তাদের অর্জিত ডিগ্রীর সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসংস্থান না পেয়ে কর্মহীন থাকে। এর ফলে তাদের মূল্যবান সময়ের অপচয় হচ্ছে এবং তাদের থেকে সৃজনশীল উৎপাদনশীলতা থেকে দেশ ও জাতি বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি তারা নিজেরাও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষাজীবন শেষে কোন কাজ যে ছোট কাজ নয় এ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যে কোন অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নিয়োজিত থাকতে পারলে বেকার সমস্যা বলে কিছুই থাকবে না। বর্তমানে দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না, এই অভিযোগ আর দৃশ্যমান হবে না।
মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। নারী কিংবা পুরুষ তাকে বিবেক-বুদ্ধি, জ্ঞান ও বিচক্ষণতাসম্পন্ন করে অন্যান্য জীব থেকে আলাদা করেছেন। এসব সমস্যায় তার দুটি হাত ক্রিয়াশীল হতে হবে সবসময়। তবেইতো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন সম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, কর্মহীন অলসতা জীবন নয়। কথায় আছে, অহ বারষং নৎধরহ রং ঃযব ফবারষং ড়িৎশংযড়ঢ়. সুতরাং আর বিলম্ব নয় শ্রমঘনিষ্ট বৈধ সকল কাজে জড়িয়ে পড়তে হবে।

লেখক : সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট