চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তিয়েনমান স্কয়ার-গণতন্ত্রকামীদের বাতিঘর

ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

২৮ জুন, ২০১৯ | ১:১৭ পূর্বাহ্ণ

বেইজিং পৌরসভাতে মানববসতির প্রাচীনতম দিকগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন: ফাংশান জেলার ঝাউকোডিয়ান গ্রামের কাছাকাছি ড্রাগন পাহাড়ের গুহায়। গুহা থেকে যড়সড় বৎবপঃঁং- জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া গেছে ২ লক্ষ ত্রিশ হাজার বছর থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাজার বছর আগে। প্যালিওলিথিক হোমো সেপিয়েন্স প্রায় ২৭ হাজার বছর আগে এখানে বসবাস করত। প্রত্নতাত্বিকরা শহর জুড়ে অবস্থিত ওয়াংফুজিংসহ পৌরসভা জুড়ে বসতি স্থাপন করেছে। বেইজিং এ প্রথম শহরটির রাজধানী জেসেং ছিল এবং এটি ১হাজার ৪৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নির্মিত হয়েছিল। লিয়াও রাজবংশের সময় ১১২০ সালে নির্মিত হয়েছিল টিয়ানিং পাগোডা। একসময় বেইজিং শহরটিকে ইয়ানজিন বা ইয়ান ক্যাপিটাল নামে ডাকা হত। ১১২২ খ্রিষ্টাব্দে লিয়াও জুরচেন জিন রাজবংশে পতিত হন এবং ১১২৫ সালে উত্তর চীন জয়লাভের সময় এটি পূনরুদ্ধার হয়।
১১৫৩ সালে জুরচেন জিন বেইজিংকে সেন্ট্রাল ক্যাপিটাল হিসাবে তৈরি করেছিলেন। ১২১৩ সালে শহরটি চেংগিস খানের আক্রমণাত্নক মঙ্গোলীয় সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফরবিডেন সিটির টাওয়ারগুলোর মধ্যে একটি, যা মিং রাজবংশের স¤্রাট দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। ১৪২৮ সালের ২৪ অক্টোবর বেইজিং শহরটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিং রাজবংশের রাজধানী হিসাবে চিহিৃত করা হয়। বেইজিং সা¤্রাজ্যের প্রাথমিক রাজধানী ইংতিয়ান, যার নাম নানজিং (দক্ষিন রাজধানী) নামে পরিচিত। সাধারণত বিশ্বাস করা হয় যে, বেইজিং বিশ্বের ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮তম শতাব্দির সবচেয়ে বড় শহর। ১৬৪৪ সালে লি জেসেং এর কৃষক সেনা দ্বারা বেইজিংয়ের অধিগ্রহণ রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে। ট্যুর গাইড মি. হ্যারিস আমাদেরকে চীনের ঐতিহাসিক তিয়েনমান স্কয়ারে নিয়ে গেলেন। এটি রাজধানী বেইজিং এর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। তিয়েনমান কথার অর্থ হচ্ছে স্বর্গীয় শান্তির দ্বার, যেটি চীনের বেইজিং এর উত্তরে অবস্থিত ফরবিডেন সিটি থেকে পৃথক করেছে। এখানে রয়েছে জাতীয় বুদ্ধের মূর্তি, গ্রেট হল অব দ্যা পিপ্ল, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, সধড় ুবফড়হম- এর সমাধি- যিনি ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর এ স্কয়ারটি প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপিত হয় এখানে। তিয়েনমান স্কয়ার পৃথিবীর প্রধান ১০টি বৃহত্তম সিটি স্কয়ারসমূহের অন্যতম যার আয়তন ১০৯ একর। এখানে চীনা সা¤্রাজ্যের সংস্কৃতি, প্রত্নতাত্বিক সাহিত্য, চাইনিজ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টগুলো রয়েছে। ১৯৮৯ সালে বেইজিং এর ছাত্রদের নেতৃত্বে যে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা এখনো পৃথিবীর মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয়। সেজন্যে চীনের বাইরে এটিকে বলা হয় তিয়েনমার স্কয়ার বিক্ষোভ। এটি ১৯৮৯ সালের ৪ জুন সংঘটিত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক আন্দোলন নামে পরিচিত।
এ বিক্ষোভকে বেইজিংবাসী ব্যাপকভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এ বিক্ষোভের কারণে চীনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। মিং রাজবংশের সময় ১৪১৫ সালে এ স্কয়ারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৭০০ শতাব্দিতে লি জি চেং বিদ্রোহী গ্রুপ ও মাং চু এর নেতৃত্বে রাজবংশের মধ্যকার যুদ্ধে স্কয়ারের গেইটটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রায় ২০০ বছর পর স্কয়ারটি পূণর্নির্মিত হয় ১৬৫১ সালে। এরই মধ্যে মোট ৪ বার এটির আকার বৃদ্ধি করা হয় এবং ১৯৫০ সাল থেকেই বর্তমানের আকার অপরিবর্তিত রয়েছে। স্কয়ারের গেইটটি কিং রাজবংশের নামানুসারে গ্রেট কিং গেইট নামে অভিহিত হয় এবং সাধারণ্যে এটি মধঃব ড়ভ পযরহধ নামে পরিচিত। এটি মধঃব ড়ভ ঃযব হধঃরড়হ নামেও পরিচিত। গেইটটি সাধারণত বন্ধ থাকে শুধুমাত্র যখন রাজা উক্ত গেইট দিয়ে প্রবেশ করেন, তখন খুলে দেয়া হয়। ১৮৬০ সালে দ্বিতীয় ড়ঢ়রঁস যুদ্ধে যখন ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের সৈন্যবাহিনী বেইজিং-এ প্রবেশ করে তখন উক্ত গেইটের আশেপাশে তারা ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৯০০ সালে বক্সার ৎবনবষষরড়হ এর যুগে অষ্ট জাতি বাহিনী অফিসগৃহ এবং অনেকগুলো মন্ত্রিপরিষদ কক্ষ ভাংচুর ও ধ্বংস করে। বক্সার ৎবনবষষরড়হ এর যুগ শেষে উক্ত স্থানটি বিদেশী শক্তির জন্যে সৈন্যবাহিনী থাকার স্থান করে দেয়া হয়। ১৯৫৪ সালে মধঃব ড়ভ পযরহধ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার পর তিয়েনমান স্কয়ারের আকার বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৮ সালের নভেম্বরে স্কয়ারের বর্ধিতকরণ সংস্কার শুরু-যেটা শেষ হয় ১৯৫৯ সালের আগস্টে, এতে সময় লেগেছিল ১১ মাস। সধড় ুবফড়হম এর ভিশন ছিল স্কয়ারকে বৃহত্তর পরিসরে পরিণত করা- তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এবং স্কয়ারটি পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত জায়গা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং এতে ধারণক্ষমতা ৫ লক্ষ। এ সময় বিপুল সংখ্যক আবাসিক ভবন এবং অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়া হয়।
স্কয়ারের দক্ষিণাংশে দেশের বীর পুরুষদের মূর্তিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। চীনের ১০ম বার্ষিকীতে মৎবধঃ যধষষ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব এবং হধঃরড়হধষ সঁংবঁস ড়ভ ঃযব পযরহধ স্কয়ারের পশ্চিম এবং পূর্ব অংশে স্থাপিত করা হয়। প্রতিবছর পহেলা অক্টোবর চীনের জাতীয় দিবসে তিয়েনমান স্কয়ারে সামরিক কুচকাওয়াজ হয়। পরবর্তীতে প্রতি ১০ বছর অন্তর অন্তর করা হত। পুনরায় ১০ বছর পর ১৯৭৯ সালে আবার আগের মতন বড়সড় কুচকাওয়াজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ এবং ২০০৯ সালে পর্যায়ক্রমে ৫০ এবং ৬০তম বার্ষিকী উদযাপিত হত ঢ়বড়ঢ়ষবং ৎবঢ়ঁনষরপ ড়ভ পযরহধ। ২০১৫ সালের ৮মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭০তম বার্ষিকী উদযাপনের সময় সামরিক কুচকাওয়াজ হয়। ১৯৭১ সালে তিয়েনমান স্কয়ারে কার্ল মার্কস, ফ্রেড্রিক এনজেল্স, ভøাদিমির লেলিন, জোসেফ স্ট্যালিন, মাও জিডং এর স্মৃতিস্তম্ভ উত্তোলন করা হয়। যাদেরকে চিত্রায়িত করেন শিল্পি মব ীরধড়মঁধহম। ১৯৮০ সালে মাও জিডং এর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক আদর্শ ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে শুরু করে। যার ফলে স্মৃতিস্তম্ভগুলো ধীরে ধীরে স্কয়ার থেকে অপসারণ করা হয়। শুধুমাত্র পহেলা মে শ্রমিক দিবস এবং জাতীয় দিবসে তা উত্তোলন করা হয়। অন্যদিকে ১৯৮৮ সালে চীনা নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেয় যে, ংঁহ ুধঃংবহ এবং মাও জিডং এর মূর্তিস্তম্ভ শুধুমাত্র জাতীয় দিবসে উত্তোলন করা হবে। ১৯৭৬ সালে মাও এর মৃত্যুর পর স্কয়ারের আকার আরো বৃদ্ধি পেয়ে ৬ লক্ষ লোকের সংকূলানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯০ সালে স্কয়ারের নগরায়ন সুবিধা পরিবর্তিত হয়। সাথে ন্যাশনাল গ্রান্ড থিয়েটার এবং ন্যাশনাল মিউজিয়াম এর বিশদ সংস্কার হয়।

লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব, জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট