চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রসঙ্গ ঃ বায়ু দূষণ

১৩ জুন, ২০১৯ | ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এবারের স্লোগান ছিল “অরৎ চড়ষষঁঃরড়হ” (ডব পধহ’ঃ ংঃড়ঢ় নৎবধঃযরহম, নঁঃ বি ফড় ংড়সবঃযরহম ধনড়ঁঃ ঃযব য়ঁধষরঃু ড়ভ ধরৎ ঃযধঃ বি নৎবধঃযব)। অবিরত বায়ু দূষণের প্রেক্ষাপটে এবারের স্লোগানটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আমরা তো আর নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাঁচতে পারবো না। শরীরকে সচল রাখতে হলে নিঃশ্বাস তো আমাদের নিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে যে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছি সেগুলোর মান দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাতাসের সাথে প্রচুর দূষিত গ্যাস মিশ্রিত হয় এবং আপনা-আপনি ভাবে শরীরে প্রবেশ করে অসময়ে চলে যেতে হয় বহু মানুষকে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ এ বায়ু দূষণের শিকার হয়ে মারা যায়। বায়ু দূষণের শিকার হয়ে মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা অগণিত।
ক্যান্সার রোগের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে এ বায়ু দূষণ। কিন্তু আমরা যদি নিজেরা সচেতন হয়ে, মানুষের মনুষত্ব জাগ্রত করতে সমর্থ হতাম তাহলে এ বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হতাম। যারা বায়ু দূষণ করছেন তারা সবাই আমাদের সমাজেরই মানুষ। তাদেরকে বুঝাতে হবে এ বায়ু দূষণ করে ব্যবসা করলে সমাজের কোন সুফল আসবে না। বায়ু দূষণ করে ব্যবসা করলে বিনিময়ে আমরা একটি অসুস্থ জাতি পাবো। একটি অসুস্থ জাতি কারোরই কাম্য নয়।
স্বাস্থ্য যেখানে সকল সুখের মূল সেখানে দূষিত বায়ু ছড়ানোর অর্থ পুরো জাতিকেই ধ্বংস করার শামিল। যারা নির্বিচারে পরিবেশ দূষণ করেন তারা কী বিবেচনা করেন না, এ পরিবেশ দূষণ তার পরিবারকেও গ্রাস করছে? তার ছেলে-মেয়ে, বাবা-মাসহ সকল আপনজন প্রত্যক্ষভাবে তার মাধ্যমে বায়ু দূষণের শিকার হচ্ছেন! আমাদের মনে রাখা উচিত বায়ু দূষণের কোন সীমানা নেই। এটা আপনার ইটভাটা/কারখানা/গাড়ী থেকে ধোঁয়া নির্গত হয়ে অতঃপর বায়ুতে মিশ্রিত হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে আপনার নিজ শরীরেও প্রবেশ করছে। বায়ু দূষণের সাথে যারা সক্রিয়ভাবে জড়িত তারা নিজেরা এগিয়ে না আসলে বায়ু-দূষণ কখনো থামবে না। অনেক হয়েছে। এবার মনুষত্বের বিবেক জাগ্রত করুন।
প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয়। আমরা যে কোন শিল্প কারখানা স্থাপন করি না কেন, সকল প্রকার কারখানার জন্য বায়ুদূষণ রোধক প্রযুক্তি রয়েছে। পরিবেশ আইনে বায়ুদূষণ রোধক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কারখানা স্থাপন বাধ্যতামূলক। কিন্তু তবুও বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার মালিকারা আইনের ফাঁক ফোকর গলিয়ে এই ঘাতক ইটভাটা/কারখানাগুলো চালাচ্ছেন। আমরা জানি বাংলাদেশের বায়ুর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো ইটভাটা। এই ইটভাটার জন্যও কিন্তু কার্যকরী বায়ু প্রতিরোধক প্রযুক্তি আছে। এই ইটভাটা জমির টপসয়েল বিনাশ করে মাটির উর্বরতা শক্তিকে যেমন নষ্ট করে, অন্যদিকে ইট পোড়নোর সময় দূষিত বায়ু (চিমনি সহকারে) সরাসরি খোলা আকাশে চলে যায়। আবার ইট পোড়ানোর জন্য যে উপকরণ ব্যবহার করে তা হলো পরিবেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু ‘সবুজ’ গাছ নিধন করে নয়তো বিষাক্ত কয়লা পুড়িয়ে।
গ্রামে-গঞ্জের বন-বাদাড় নির্বিচারে সাবাড় হচ্ছে মূলত ইটভাটার জন্যে। ইটের বিকল্প আমরা বের করতে না পারলে অথবা পরিবেশ বান্ধব ইটভাটা তৈরি করতে মালিকদের বাধ্য করানো না গেলে কপালে আরো দুঃখ আছে। আমরা পুরাতন ফিক্সড চিমনী ইটভাটার (এফসিকে) পরিবর্তে যদি উন্নতমানের জিগজ্যাগ ইটভাটায় (আইজেডকে) উন্নীত করতে পারতাম তাহলে বায়ুদূষণ ৪০% এর মতো হ্রাস পেতো। আর যদি ফিক্সড চিমনী ইটভাটার (এফসিকে) পরিবর্তে যদি আরো উন্নতমানের ভার্টিকেল স্যাফট ইটভাটা (ভিএসবিকে) বা জার্মানীর প্রযুক্তির হাইব্রিড হপম্যান ইটভাটা (এইচএইচকে) স্থাপনে সমর্থ হতাম তাহলে বায়ুদূষণ ৬০%এর মতো হ্রাস পেতো।
গতানুগতিক ইটভাটাগুলোর চাইতে হাইব্রিড হপম্যান ইটভাটা স্থাপনে বেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন হলেও এই প্রযুক্তির ইটের গুণাগুণ মান এবং উৎপাদন ক্ষমতা বেশী হয়। উৎপাদন খরচেও তেমন তারতম্য নেই। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫০টির অধিক হাইব্রিড হপম্যান ইটভাটা রয়েছে। বাংলাদেশের ইটভাটাগুলোকে পর্যায়ক্রমে হাইব্রিড হপম্যান ইটভাটায় রূপান্তর করতে পারলে বাংলাদেশের বায়ুর মান অনেক স্বাস্থ্যকর হতো। আর গতানুগতিক অবৈধ ইটভাটাগুলো কালবিলম্ব না করে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। স্টিল ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন কলকারখানার জন্য রয়েছে এয়ার পলিউশান কন্ট্রোলার (এপিসি) প্রযুক্তি। কিন্তু বাংলাদেশের গুটি কয়েক ফ্যাক্টরী বাদে অন্য কোন স্টিল বা ভিন্নবর্ণের কারখানাতে এপিসি নেই। এয়ার পলিউশান কন্ট্রোলার ছাড়া ফ্যাক্টরির সক্রিয়তা থাকা উচিত নয়। এপিসির মাধ্যমে ধৃত ডাস্টগুলো কিন্তু রপ্তানীও করা যায়। চট্টগ্রামের একটি নামী-দামী স্টিল কারখানা ধৃত এ ডাস্টগুলো বিদেশী রপ্তানী করে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। সুতরাং এপিসি সংযোজনের মাধ্যমে বায়ুদূষণ যেমনভাবে রোধ করা সম্ভব, তেমনিভাবে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন সম্ভব। এটা আমাদের শিল্পকারখানার অধিকাংশ স্বত্বাধিকারীরা জানেন না। এপিসি না থাকলে কার্বন ডাইওক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, পার্টিকেলস, টক্সিক পদার্থ, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনস, এ্যামোনিয়া, প্যারোক্সিয়া নাইট্রেট এবং বিষাক্ত দুর্গন্ধ ধোঁয়া বায়ুর সাথে মিশ্রিত হয়ে তা মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তির ঘটাচ্ছে।
এই বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রায় ৮৮ লক্ষের মতো মানুষ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে। শিল্পকারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধনের জন্য রয়েছে ইটিপি বা ইপ্লুয়্যান্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রযুক্তি। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোর জন্য এই ইটিপি বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে এই অবধারিত ইটিপি নেই। আবার যারা সংযোজন করেছেন তাঁদের অধিকাংশই খরচ বাঁচানোর জন্য ইটিপিগুলো বন্ধ রাখেন। দায়সারাভাবে ব্যবসা করার বা কারখানা চালানোর প্রবণতা আমাদের সমাজে চালু আছে। এই অনৈতিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। গাড়ীর বায়ুদূষণের জন্যও আছে ভেহিক্যাল এয়ার পলিউশান কন্ট্রোল সিস্টেম বা ভেহিক্যাল ইমিশনস্ কন্ট্রোলার। গাড়ীর মধ্যে সাধারণত ডিজেলে চালিত গাড়ীগুলো প্র্রচুর বায়ু দূষণ করে। ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাস-ট্রাকের মধ্যে ভেহিক্যাল ইমিশনস্ কন্ট্রোলার লাগানো বাধ্যতামূলক করলে রাস্তাঘাটে বায়ু দূষণ প্রচুর পরিমাণে হ্রাস পেতো।
এভাবে সকল শিল্প কলখারখানার বায়ুদূষণরোধের প্রযুক্তি আয়ত্তে থাকলেও শুধুমাত্র শিল্প মালিকদের বড় একটি অংশের অনীহার কারণে তাদের নিজ নিজ শিল্প কলকারখানায় এ প্রযুক্তিগুলো সংযোজন করে না। শিল্প মালিকেরা বায়ু দূষণরোধের এ প্রযুক্তি সংযোজিত করলে একদিকে তাঁদের শিল্পগুলো যেমন টেকসই হতো অন্যদিকে দেশ ও জনগনের বড় উপকার হতো। প্রকৃতি ধ্বংস করে বায়ু বিষাক্ত করে দায়িত্বজ্ঞানহীন শিল্প কারখানা চালু রাখা কারো কাম্য নয়। মনে রাখতে হবে, পৃথিবী একটাই। এটা আমাদের বাসযোগ্য রাখতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর অত্যাচার করলে সেটা আমাদের দিকেই ফিরে আসবে। প্রকৃতি ইতিমধ্যে প্রতিশোধের মাত্রা বাড়িয়ে চললেও জনগন সেভাবে সাবধান হচ্ছে না। আসুন জাতীয় পতাকার মূল রং সবুজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এ দেশের বায়ুকে নির্মল ও পরিশুদ্ধ রাখি যাতে আমরা প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি।

লেখক : পরিবেশকর্মী, কলাম লেখক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট