চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রসঙ্গ : অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার

জিয়া হাবীব আহসান

১ জুন, ২০১৯ | ১:৫১ পূর্বাহ্ণ

অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের বা আইনজীবী নিয়োগের অধিকার অলংঘনীয়। যে কোন অপরাধে অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। নইলে ন্যচারাল জাস্টিস বা স্বাভাবিক ন্যায় বিচার ব্যাহত হবে। এটা বাদী বিবাদী সকলের সাংবিধানিক অধিকার। কেননা বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যায় না।
আমাদের দেশের আইনে খুন, গুম, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, পাচার, ছিনতাই, ধর্ষণ, ডাকাতি, এসিড সন্ত্রাস এমন কি মানবতা বিরোধী অপরাধের মতো অপরাধের আসামীদের প্রত্যেকের আত্মপক্ষ সমর্থনে আইনজীবী নিয়োগের অধিকার রয়েছে। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে পরিচ্ছন্ন ট্রায়েলের স্বার্থে রাষ্ট্র বাদীপক্ষে যেমন পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) নিয়োগ দেয় আসামী পক্ষকেও বিনামূল্যে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে থাকে। এমন কি গুরুতর অপরাধের পলাতক আসামীদের পক্ষে সরকারী খরচে ঝঃধঃব ফবভবহংব ষধুিবৎ নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাকে রাষ্ট্র পক্ষ সংশ্লিষ্ট পলাতক আসামীর যাবতীয় নথিপত্র সরবরাহ করা হয়।
যেমন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা মামলায়ও পলাতকদের পক্ষে সরকারী খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। নইলে বিচার একতরফা হয় ও বিচারের রায় ঔঁংঃরভু হয় না। রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে সঠিক তদন্ত এবং সাক্ষ্য প্রমাণ, দলিলপত্র, এক্সপার্ট ওপিনিয়ন, আলামত ইত্যাদির মাধ্যমে অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ করা। বিচারক উভয়পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের যুক্তি-তর্ক, সাক্ষ্য, সাবুদ, স্বীকারোক্তি, জেরা জবানবন্দী, নথিপত্র ইত্যাদি বিচার-বিবেচনায় আসামীকে সাজা বা খালাস দেন। প্রয়োজনে ১০ জন অভিযুক্তের ৯জন খালাস পেলেও একজন নিরপরাধ ব্যক্তির যেন সাজা না হয় সে জন্য বিচারক মহোদয়কে সতর্ক থাকতে হয়। নইলে তা হবে একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধ।
সুতরাং বিচার চলাকালে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর অলঙ্ঘনীয় স্বাধীনতা রয়েছে অভিযুক্তের পক্ষে ওকালতি করার। এটা একজন আইনজীবীর নিরংকুশ পেশাগত স্বাধীনতা। এটায় হস্তক্ষেপ করা মানে দেশকে মঘের মুলুক বানানো বা নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়া। এতে ক্ষমতার অপব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। বহু ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায় যে, নাম বিভ্রাট, তথ্য বিভ্রাটের কারণে অনেক নিরাপরাধ মানুষ বছরের পর বছর গুরুতর অপরাধী হিসেবে জেল খাটছে। তাদের মুক্ত করতে আইনী সহায়তা দিতে হয় আইনজীবীকে।
আমরা দেখেছি অনেক নিরপরাধ মানুষকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। আইনজীবীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের নিরপরাধ প্রমাণ করে মুক্ত করেন। সুতরাং মানবাধিকার রক্ষায় একজন আইনজীবীর ভূমিকা অপরিসীম। অসংখ্য মৌলিক আইনগ্রন্থের প্রণেতা মরহুম গাজী শামসুর রহমান বলেন, “কোন মানুষ ভ্রমের উর্ধ্বে নয়। সম্ভবতঃ বিচারকও নয়। বিচারকের ভ্রম ধরিয়ে দিতে পারেন শুধু সেই ব্যক্তি যিনি জ্ঞানে, গুণে, মর্যাদায় এবং অবস্থানে বিচারকের সমকক্ষ। সেই ব্যক্তিই আইনজীবী।”
পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে কোন আইনজীবীকে দায়ী বা অভিযুক্ত করা যাবে না (১৯৯৩ বিএলডি -এডি পৃষ্ঠা ১৫২)। বিচারাধীন মামলায় আইনজীবী যাতে তার দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তজ্জন্যে আইনজীবীকে অপমান করাও আদালত অবমাননার অপরাধ। রাষ্ট্রপক্ষের মামলা প্রমাণে চরম গাফেলতি, তদন্ত কালে মামলার অপরাধীকে বাঁচানোর জন্য ফাঁকফোকর সৃষ্টি করা, সাক্ষ্য-সাবুদ উপস্থাপন না করা, আলামত নষ্ট করা, মামলা প্রমাণে যা যা করার তা না করে মামলা যাতে প্রমাণ না হয় তার জন্য একটা তদন্তের মহড়া করার কারণে অনেক সময় অপরাধীর সাজা হয় না । ফলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি হয়।
বিচার ব্যবস্থার সাথে জড়িত প্রতিটি অঙ্গকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামীপক্ষ উভয়পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীর বিচক্ষণতা ও সহায়তায় বিচারক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। এজন্যে বিজ্ঞ আইনজীবীদের বলা হয় অফিসার্স অব দ্যা কোর্ট। সুতরাং আইনজীবী ছাড়া আমাদের বিচার ব্যবস্থা অচল। আশা রাখি এই ক্ষুদ্র আলোচনার মাধ্যমে অভিযুক্তের পক্ষের আইনজীবী নিয়োগ বা ওকালতির বিষয়ে সকল বিতর্কের অবসান হবে ।

লেখকঃ আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট