চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কর্ণফুলী কেবল চট্টগ্রামের নয় দেশের অর্থনীতিরও প্রাণ

২৯ মে, ২০১৯ | ১:৪৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর দান। এই কর্ণফুলী নদী এখন বিপণœ। একদিকে চর জেগে ভরাট হয়ে ‘লুসাই কন্যা’ খ্যাত সুনাব্য নদী কর্ণফুলী ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে গতি প্রবাহের সরল ছন্দ, অপরদিকে মানুষেরই আচরণেও বিঘিœত হচ্ছে বহতা এ নদীর প্রাণ। ফলে, এই নদী হারিয়ে ফেলছে তার কল্যাণী ভূমিকা। নদীকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে সভ্যতা। বিকশিত হয় নদীকে ঘিরেই। গড়ে উঠে জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, অর্থনীতি ও সমাজ বহুকাল ধরে কর্ণফুলী নদীর অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ হয়েছে চট্টগ্রামবাসীর জীবন। তাই, এ নদী বিপণœ হলে তা বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। দুর্যোগের সংকেত বহন করে আনে, চট্টগ্রামের জন্যে।
বিপণœতার কারণ অনেক। অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে এ নদীর স্বাভাবিক জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে কংক্রিটের সেতু নির্মাণ, ভূমিদস্যুদের নদী-দখল ও ভরাটকরণ, স্থাপনা নির্মাণ, হাজার হাজার টন নাগরিক বর্জ্য নিক্ষেপ, শিল্প-কারখানাসমূহের দূষিত বর্জ্য ও রাসায়নিক তরল ইত্যাদির মাধ্যমে নদীর পানি দূষিতকরণ – এমনই অজ¯্র অপব্যবহারমূলক কর্মকা-ের শিকার হয়ে চলেছে এই কর্ণফুলী নদী। একশ্রেণীর মানুষের লোভ ও স্বার্থ-চিন্তার আচার-আচরণ এমনই সর্বনাশা যে, তারা লোকজীবনের ভালো-মন্দের কোনো বিবেচনাই রাখে না। আগ্রাসী প্রবণতার মধ্য দিয়ে আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতিকে উপেক্ষা করে স্বার্থ হাসিলের জন্যে সর্ব সাধারণের স্বার্থকেই বলি দেয়। ডেকে আনে ব্যাপক জনগোষ্ঠির জন্য অমঙ্গলের দিনকাল, চাপিয়ে দেয় অকল্যাণের দুঃসহ বোঝা। যুগ-যুগান্তর ধরে নীরবে বহতা কর্ণফুলী আজকের দিনগুলোতে এমনই কিছু অশুভ শক্তির অপতৎপরতার জালে বন্দী হয়ে পড়েছে।
কর্ণফুলীর নাব্যতা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক ভাবেই হ্রাস পাচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর কোলাগাঁও, পূর্ব বাকলিয়া, চরপাথরঘাটা চর-চাকতাই, সদরঘাট, বাংলাবাজার প্রভৃতি নানা এলাকা জুড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। আশঙ্কার বিষয় হলো, এ সমস্ত চর ক্রমান্বয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অভিমুখে সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে, প্রশস্ততা অর্জন করে চলেছে। এর ফলে বন্দর চ্যানেল হুমকির মুখে পড়তে চলেছে। নৌ চলাচলেও বিঘœ দেখা দিচ্ছে। সঙ্কটের চিত্রটি সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের অজানা তা নয়। অনেকেরই অভিমত চর পড়ে নাব্যতা বিনষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ হলো নদীর স্রােতধারায় প্রতিবন্ধকতা স্থাপন করে দু’দুটি সেতু নির্মাণ। সেই সাথে নদীর দু’পাড় ভরাট করে জমি দখল করে নেওয়া ও নদীর নানা অংশ থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন ইত্যাদি। এ সমস্ত নাশকতাধর্মী কর্মকা- বন্ধ করার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এখনও যে সম্ভব হয় নি, এটাই একটি বড়ো ধরনের দুঃসংবাদ চট্টগ্রামবাসীর জন্য।
জানা যায়, ক্ষমতাবান পক্ষ কর্ণফুলী নদীর দু’পাড়ে দখলদারিত্ব কায়েম করে লিপ্ত রয়েছে বেপরোয়াভাবে নদী ভরাটের কাজে। আর, সেই সব স্থানে গড়ে তুলছে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো। নদী খাত থেকে বেআইনীভাবে বালি তুলে নিয়ে নির্মাণ করছে বাড়ি, অফিস, জেটি, বরফ কল গুদাম ইত্যাদি। এই জাতীয় অবৈধ কর্মকা-ের ফলে নদীখাতের স্থানে স্থানে সৃষ্ট গর্তের গভীরতায় নদীর জল-প্রবাহের স্বাভাবিক গতি বাধা পেয়ে এবং আবর্তিত হয়ে কোনো কোনো এলাকায় ভাঙনের সর্বনাশের সূচনা করছে। আবার, কোথাও কোথাও পলি জমি ওঠার কারণ হয়ে চরের জন্ম নিচ্ছে।
নদী কর্ণফুলীকে ভরা জোয়ারের সময় দেখলে বোঝার কোনো উপায় থাকে না যে এ নদীতে রয়েছে অসংখ্য চরের ক্যান্সার। যা, জালের মতো ব্স্তিীর্ণ এলাকাতে ছড়িয়ে গিয়ে নদীর নাব্যতা হনন করে চলেছে। জোয়ারে চরগুলোর বেশীরভাগই জলের নীচে ডুবে গেলেও, কিছু কিছু চর আছে, যা মাত্র ২/৩ ফুট জলর নীচেই অবস্থান করে। এই ডুবোচেরর ফলে কর্ণফুলীর একটি বিস্তীর্ণ জলভাগ এই সময়ে নৌকা, ট্রলার, বোট ইত্যাদি চলাচলের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। জেলেদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, মাছ ধরার নৌকা, মালবাহী ট্রলার, যাত্রীবাহী লঞ্চ প্রভৃতি চলাচলের জন্য এই নদীতে অনেক জায়গায় ন্যূনতম ৭/৮ মিটার গভীরতা না থাকায় ভাটার সময় তিন ঘণ্টা করে দৈনিক দু’বার নৌ-চলাচল সীমিত করে আনতে হয়। শাহ আমানত সেতু নির্মাণের আগে চাকতাই খালের মুখ থেকে কর্ণফুলীর মোহনা পর্যন্ত ২০ মিটার নাব্যতা থাকলেও, সম্প্রতি তা কোথাও কোথাও মাত্র ১০/১২ মিটারে এসে পৌঁছেছে।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে কর্ণফুলী নদীর বিপণœতা দূরীকরণ ও এর নাব্যতা রক্ষার্থে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। কর্ণফুলী রক্ষা পেলে কেবল যে, চট্টগ্রামই বাঁচবে তা নয়, সমগ্র দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে কর্ণফুলী নদীকে তার আগেকার কল্যাণীরূপ ফিরিয়ে দেওয়ার কথাই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভাবতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট