একপাশে জীবনসঙ্গী, অন্যপাশে আদরের কন্যা। আর মাঝখানে তিনি, আজিজা সুলতানা। স্বামী-স্ত্রীর পরনে গর্বের প্রতীক, স্বপ্নপূরণের ঘোষণার চিহ্ন-গ্র্যাজুয়েশন গাউন। চোখমুখে প্রশান্তির দীপ্তি, ঠোঁটের কোণে অনুচ্চারিত বিজয়ের হাসি। সুখী পরিবারটির মাঝে যেন তখন বয়ে যাচ্ছিল শিশিরভেজা সকালের মতো এক কোমল মুহূর্ত।
১৪ মে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তনের দিন, সবুজ ক্যাম্পাসের ছায়াতলে তোলা ছবিটা আজিজা শেয়ার করেছিলেন ফেসবুকে; শুধু একটিই শব্দ ছিল ক্যাপশনে, ‘অবশেষে!’ কিন্তু কে জানতো, জীবনের শতরঙে আঁকা সেই ফ্রেমই হয়ে উঠবে আজিজার শেষ স্মৃতি! বুধবারের নিষ্ঠুর রাত স্বজনদের কাছ থেকে আজিজাকে কেড়ে নিয়েছে, চিরতরে। আজিজার সেই হাসিমাখা মুখ এখন তাই বেদনার শেলের মতো বিঁধছে প্রিয়জনের বুকে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিলেন আজিজা। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে অদম্য মেধাবী আজিজা যোগ দিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে। তার স্বামী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানও ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। বর্তমানে তিনি সরকারি কমার্স কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক। আজিজা ছিলেন সন্তানসম্ভবা। আর কদিন পরই দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখার কথা ছিল এই দম্পত্তির। কিন্তু শারীরিক জটিলতা বাড়তে থাকায় আজিজাকে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রামের বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে।
যকৃতের প্রদাহ ক্রমেই অবনতির দিকে গেলে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিতে হয়। আর সেখানেই বুধবার রাত ৩টায় সব চেষ্টা, সব প্রার্থনা, সব চোখের জল ব্যর্থ করে আজিজা চলে যান না ফেরার দেশে। মায়ের মৃত্যুতে গর্ভের সন্তানটিরও পৃথিবীর মুখ দেখা হলো না; মায়ের সঙ্গেই যে মারা যায় সেও।
প্রিয়তমাকে হারিয়ে একেবারেই ভেঙে পড়েন মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান মামুন। ফেসবুকে জড়সড় ভাষায় তিনি লিখেছেন, ‘ইচ্ছে ছিল তোমাকে সঙ্গে নিয়ে লিখবো এক মহাকাব্য। কিন্তু না, তা আর হয়ে উঠলো না। আমাদের গল্পটা শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেলো।’
আসাদুজ্জামানের হৃদয়ের আকুতি আরও গভীরভাবে ফুটে ওঠে আরেকটি স্ট্যাটাসে, ‘তোমার জন্য আমার ভালোবাসার গভীরতা অনেক, কিন্তু মহান রবের ভালোবাসা ছিল আরও বেশি। তাই সসীম ভালোবাসা ছেড়ে চলে গেলে অসীম ভালোবাসার দিকে। হাজার চেষ্টা, হৃদয়ের আকুতি, চোখের জল- কিছুই তোমাকে ধরে রাখতে পারলো না।’
আজিজা ছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ শরিফুল হকের বোন; বয়সে পিঠাপিঠি। ভ্রাতৃস্নেহে বাঁধা সেই সম্পর্ক ফেসবুকেই কখনও ধরা দিতো হাসির খুনসুটিতে। আজ সেই ভাই হারিয়েছেন হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষটিকে। বোন হারিয়ে কথা বলার সব শক্তিই যেন হারিয়েছেন তিনি। প্রাণপ্রিয় বোনের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন শরিফুল হক।
বন্ধুদের স্মৃতিতেও আজিজার সঙ্গে কাটানো সময়েরা ফিরে আসছে বারবার। আজিজাকে হারিয়ে বন্ধুদের ফেসবুক যেন পরিণত হয়েছে এক একটি শোক-বইয়ে। সেই বন্ধুদের একজন উম্মে হাবিবা লিখেছেন, ‘আড্ডা, খুনসুটি তুই ছাড়া জমতোই না। কত হাজারো স্মৃতির ভিড়ে তুই সবসময় জীবিত ছিলি আমার কাছে। আত্মার একটা বড় অংশ জুড়ে তুই ছিলি। তুই আমার বান্ধবী কম, বোন ছিলি বেশি। আজ সব মায়া, ভালোবাসা, বন্ধন ছিন্ন করে ওপারে পাড়ি জমালি। মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। একদিন সবাইকে যেতে হবে জানি, তবুও তোর এই অকালমৃত্যু, পেছনে ফেলে যাওয়া কত আকুতি মেনে নিতে পারছি না।’
বন্ধুদের আরেকজন সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক নজরুল ইসলামের স্মৃতিতেও আজিজা বেশ উজ্জ্বল। তিনি বলেছেন, ‘ভাবতেই পারছি না আজিজার মতো একজন ভালো মানুষ, কাছের বন্ধু আর নেই। রয়ে গেছে কেবল তার গল্প, তার ছবি, আর তার অপূরণীয় শূন্যতা।’
আর আসাদুজ্জামান? বুধবার রাত ৩টা থেকে এই শিক্ষকের পৃথিবী পুরোপুরি বদলে গেছে। একদিকে স্ত্রীকে হারানোর বেদনা, অন্যদিকে চার বছরের কন্যা ইলমাকে মায়ের অভাব ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা। দুটোই একসঙ্গে করতে হচ্ছে তাকে। এখন থেকে তাই আসাদুজ্জামান যেন একাই ইলমার বাবা, একাই ইলমার মা!
পূর্বকোণ/ইবনুর