চট্টগ্রাম শনিবার, ১১ মে, ২০২৪

দায়সারা তদন্তে অসন্তোষ আদালতের

২৪ মামলা পুনরায় তদন্তের আদেশ

নাজিম মুহাম্মদ

৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ২:২৭ পূর্বাহ্ণ

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গোয়েন্দা ও থানা পুলিশের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে (চার্জশিট) সন্তুষ্ট নয় আদালত। বিশেষ করে ইয়াবা উদ্ধার সংক্রান্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে অনেকটা দায়সারা। অধিকাংশ মামলায় শুধুমাত্র বহনকারীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে। এতে মূল পাচারকারীরা বরাবরই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। গত সাতমাসে (ফেব্রুয়ারি-আগস্ট) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৪টি মামলার পুনরায় তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নিদের্শ দিয়েছে আদালত। থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দেয়া এসব তদন্ত প্রতিবেদন সন্তুষ্ট নয় বিজ্ঞ আদালত। বেশ কয়েকটি মামলার পুনরায় তদন্ত প্রতিবেদনের আদেশে তদন্ত কর্মকর্তার দায়সরা মনোভাবের বিষয়টিও উঠে এসেছে।

মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এডভোকেট মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী জানান, একটি মামলায় মূল অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার বিষয়টি পুরোপুরি তদন্ত কর্মকর্তার উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন অজুহাতে মামলা থেকে অপরাধীদের বাদ দেয়া হচ্ছে। পাঁচ বছর আটমাস পিপির দায়িত্ব পালনকালে এসব বিষয় দেখতে দেখতে আমরা স্বাভাবিক হয়ে গেছি।
পিপি ফখরুদ্দিন বলেন, তদন্তের সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন না থাকায় যেনতেনভাবে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে আদালতে।

দায়সারা তদন্তে একদিকে মামলার বাদি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে একই ঘটনা পুনরায় তদন্ত করতে গিয়ে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।
কেসস্টাডি-১: নগরীর কোতোয়ালী থানার ফিশারিঘাট এলাকায় ঢাকাগামী একটি কাভার্ডভ্যান থেকে ২০১৮ সালের ৭ অক্টোবর ৫০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় মোরশেদ আলম ওরফে মোরশেদ, উজ্জল দাশ ওরফে সুমন দাশ ও গাড়ি চালক আবুল কালামকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইমাম হোসেন বাদি হয়ে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক তিনজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানান, তারা ইয়াবা পাচারের বাহকমাত্র। বিপুল পরিমাণ ইয়াবার মূল পাচারকারী দিল মোহাম্মদ ওরফে দেলোয়ার হোসেন দেলু। তিনমাস তদন্তের পর ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালতে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামাল হোসেন। ঘটনাস্থল থেকে আটক তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) দেয়া হলেও সঠিক নাম-ঠিকানা না পাওয়া কথা কথা জানিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী দেলোয়ারকে চার্জশিট থেকে বাদ দেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা কামাল। দেলোয়ারকে খুঁজে বের করতে বিজ্ঞ আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আদেশ দেয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। পিবিআই’র তদন্তে দেখা যায় চার্জশিট থেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তার বাদ দেয়া সেই দেলোয়ার ৫০ হাজার ইয়াবার মূল পাচারকারী। তিনি পেশাদার ইয়াবা ব্যবসায়ী। টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের ছিদ্দিক আহমদের ছেলে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ইয়াবা পাচার ও অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। তাকে চার্জশিটভুক্ত করে গত ২০ আগস্ট পুনরায় তদন্তের প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই’র পরিদর্শক (ওসি) মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন আনোয়ার।

কেসস্টাডি-২: ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার আমিন জুটমিল এলাকায় একটি মিনিট্রাক থেকে ১২ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে বায়েজিদ থানা পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে মো. আলম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। এএসআই নাছের আহাম্মেদ বাদি হয়ে থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আলমকে আটক করা হলেও ইউনুছ ও মুজিবুর রহমান নামে আরো দুই ব্যক্তি পালিয়ে গেছে। ঘটনার সাথে জড়িত নয় দাবি করে ইউনুছকে বাদ দিয়ে ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি আলম ও মুজিবুর রহমান নামে দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা বায়েজিদ থানার আবছার উদ্দিন রুবেল। বাদ দেয়া ইউনুছকে খুঁজে বের করার আদেশ দিয়ে আদালত পিবিআইকে মামলাটি পুনরায় তদন্তের আদেশ দেয়। পরবর্তীতে পিবিআই’র তদন্তে দেখা যায়, টেকনাফের জাদিমুড়ার সৈয়দ আহমদের ছেলে ইউনুছ পেশাদার ইয়াবা ব্যবসায়ী। তিনি ইতিপুর্বেও ইয়াবা পাচার করেছেন। এমনকি ইয়াবা নিয়ে বায়েজিদ থানায় ধরা পড়া ট্রাকের মালিকও ইউনুছ। ইয়াবা বহনের জন্য এগারো লাখ টাকা দিয়ে ট্রাকটি কিনেছেন তিনি।

কেসস্টাডি-৩ : নগরীর কোতোয়ালী থানায় ২০১৮ সালে পুলিশ বাদি হয়ে দায়ের করা একটি মামলায় নাম-ঠিকানা না পাওয়ার অজুহাতে মঞ্জু নামে একজন মাদক ব্যবসায়ীকে চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়। আদালতের আদেশে পুনরায় তদন্তে দেখা যায়-মঞ্জু কোতোয়ালী থানার বাটালি রোডের মৃত মোহাম্মদ রফিকের ছেলে। তিনি পেশাদার ফেন্সিডিল ব্যবসায়ী।
কেসস্টাডি-৪: ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নগরীর কোতোয়ালী থানায় দায়ের গোয়ালপাড়া তুলাতলি তিন রাস্তার মোড় থেকে ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রির অপরাধে শফিক, শাহাব উদ্দিন ও নুর হোসেন নামে তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, তারা পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। তাদের সাথে রিজিয়া ও কমলা নামে আরো দুই মহিলা রয়েছে। তারাও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। পরবর্তীতে দুই মহিলাকে মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে শফিক, শাহাব উদ্দিন ও নুর হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। দুই মহিলার মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করতে আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের আদেশ দেয়। পিবিআইয়ের তদন্তে দেখা যায় রিজিয়া ও কমলা পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। মাদক বিক্রেতা দুই মহিলার নাম সংযুক্ত করে মামলাটির পুনরায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় বিজ্ঞ আদালতে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট