চট্টগ্রাম শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪

স্রোতের বিপরীতে দুই নারী চিকিৎসকের অন্যরকম লড়াই

পাহাড় আর দ্বীপ মাড়িয়ে রোগীর টানে ছুটেন তাঁরা

ইমাম হোসাইন রাজু

৭ এপ্রিল, ২০২৩ | ২:৩৬ অপরাহ্ণ

কখনো ছুটছেন তাঁরা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকা থানচিতে। আবার বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে কখনো যাচ্ছেন কক্সবাজারের দ্বীপ এলাকা কুতুবদিয়ায়। পাহাড়, সমতল, উপকূলের মতো দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন নারীদের। অন্যদিকে, ঘরের কাছে দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পেয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত নারী রোগীরাও। ক্যান্সারসহ জটিল সব রোগের বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন তারা।
গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নেওয়া ষাটোর্ধ্ব এই দুই নারী চিকিৎসক হলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সাবেক দুই চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. রওশন মোর্শেদ ও অধ্যাপক ডা. নাসরিন বানু। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও শুধুমাত্র গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিতই প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছেন এই দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। ইতোমধ্যে তারা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজারসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্নস্থানে নারীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন। এছাড়া নারীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা, ক্যান্সার বিষয়ক সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। যা চালু রাখতে চান নিয়মিতই। নিজ উদ্যোগের পাশাপাশি তাঁদের এ কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন সহপাঠী ও গাইনি চিকিৎসকদের সংগঠন- অবস্টেট্রিক্যাল এন্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)।

এমন কাজে নিজেকে জড়ানোর প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রওশন মোর্শেদ বলেন, ‘কুতুবদিয়ার মতো একটি অজোপাড়া গ্রাম থেকে ওঠে আসা চিকিৎসক আমি। চাকরির সুবাদে প্রায় এক দশক বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিলাম। এসবের ফলে গ্রামীণ মানুষের- বিশেষ করে নারীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিস্থিতি চোখের সামনে দেখেছি। যা ভাবিয়ে তোলে আমাকে। কেননা প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা কী, সেটি ভালো করে জানেন না। তাছাড়া এখনও গ্রামের নারীদের ক্যান্সার স্ক্যানিং বা ভ্যাকসিনের বিষয়ে জ্ঞান নেই। সে জিনিসটা অনুভব করেছি। জীবনকে অন্য দৃষ্টি দিয়ে দেখেছি। ফলে এসব কাজে নিজেকে যুক্ত করি।’

বান্দরবানের গহীনে গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানের বিষয়ে অধ্যাপক ডা. নাসরিন বানু বলেন, ‘বান্দরবানের থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নের রেমাক্রীর একটি পাহাড়ি পাড়াতে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থাটা ছিল খুবই ভয়ংকর। মূল সড়ক থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে হেঁটে আবার পাহাড় বেয়ে এবং নদী পথ দিয়ে নৌকায় করে পৌঁছাতে হয়েছিল। যেখানে যাওয়ার জন্য সাধারণের অনুমতি নেই, তবুও আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় দুর্গম এলাকাটিতে পৌঁছাই। পাহাড়ের বাসিন্দাদের দেখে মনে হলো- পাহাড়ের মানুষগুলো প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন। তাদের ভাষ্য প্রায় এমন- ‘বাঁচলে বাঁচবো, মরলে মরলাম’।
আমরা যাওয়ার পর বøাড প্রেসার মাপার মেশিন দেখে পাহাড়িরা অবাক হয়ে যায়। অনেকেই দৌড়ে এসে হাত বাড়িয়ে দেন, শুধুমাত্র মেশিন দিয়ে কী হয়- তা দেখার জন্য।’

সেবা পৌঁছে দেয়ার প্রসঙ্গে ডা. নাসরিন বানু বলেন, ‘আমার দ্বারা একজন মানুষও যদি ভালো থাকে, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই নেই। শহরের মানুষ চাইলে একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেন, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষগুলোর তা সম্ভব হয় না। ক্যাম্পেইনে গিয়ে বুঝেছি, অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন। এটা যে কী পরিমাণ আনন্দের, তা কোটি টাকা দিয়েও এমন শান্তি পাওয়া যাবে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের কাছে গিয়ে সেবা পৌঁছে দিতে পারলে একটু শান্তি পাব। আমাদের এমন কর্মকাণ্ডে নিয়মিত চালু রাখতে চাই। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ কাজ নিয়মিত করার ইচ্ছে রয়েছে।’

অন্যদিকে, ডা. রওশন মোর্শেদ বলেন, ‘আমরা শতভাগ কার্যকারিতা আনতে পারবো না, তবে আশা রাখি আমাদের প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও সার্থক হবে। বেঁচে থাকতে দেখবো কিনা জানি না, তবে অনেক আত্মবিশ্বাস আছে, অন্তত যেসব স্থানে কাজ করে যাচ্ছি, এক সময় ওইসব স্থানে ভালো কিছু হবে। শীঘ্রই দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে কাজ করবো। পাশাপাশি বস্তিতে বসবাসকারী নারীদের স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

তাছাড়া ‘আমি নিজেকে কখনো ডাক্তার ভাবিনি, আমি মনে করি- আমি কারও মা, কারও বোন। যার কারণে নিজ দায়িত্বে থেকেই আমার কর্তব্য পালন করে যাই। যদিও মাঝে মাঝে মনে হয়, চিকিৎসা জীবনের শুরু থেকে যদি এভাবে কাজ করতে পারতাম, তাহলে আরও বেশি কিছু করা সম্ভব হতো। তবুও যতদিন সুস্থ থাকবো ইনশাআল্লাহ এ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই।’
প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন ছিল জানতে চাইলে ডা. রওশন মোর্শেদ বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে একটা জিনিস আমাদের নজরে এসেছে, সেটি হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন নন। নারীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ভালো মন্দ কিছুই তারা জানেন না। যার কারণে তারা বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। তাছাড়া জটিল সমস্যায় পড়লেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগ্রহটুকুও কম। শুধুমাত্র কোয়াকের কাছে গিয়েই তারা তাদের সমস্যা দূরের চেষ্টা করেন। যার কারণে জটিল রোগেরও বাসা বাঁধে তাদের শরীরে।’

এ বয়সে ক্লান্তি আসে কিনা-এমন প্রশ্নে ডা. রওশন মোর্শেদ বলেন, ‘আপনার যখন মানসিক শক্তি থাকবে, তখন শরীর কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। যখন এসব কাজে নেমে পড়ি, তখন মানসিকভাবে নিজেকে ঠিক রাখতে হয়। তাহলেই সব কিছু সম্ভব হবে।’

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট