চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সম্ভাবনা আর চ্যালেঞ্জের মাঝে নিট পোশাক শিল্প

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১:২৯ অপরাহ্ণ

গাওহার সিরাজ জামিল

 

অতিমারি করোনায় সারা বিশ্বে মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই লকডাউন, জরুরি অবস্থা কিংবা নানা বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। কাজের ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন, যা এক নতুন বাস্তবতা। কর্মস্থলে যেতে না পারা কর্মীরা ঘরে বসেই অনলাইনে কাজ করছেন। বড় আয়োজনের সামাজিক অনুষ্ঠানও বন্ধ। এর ফলে অনেক দেশেই ঘরোয়া পরিবেশে ব্যবহার উপযোগী পোশাকের চাহিদা বেড়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বলছে- গত অর্থবছরে ১,৬৯৬ কোটি ডলারের নিট পোশাক বা টি-শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টস প্রভৃতি গেঞ্জির কাপড়ের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২২ শতাংশ। এই অর্থবছরে তা আরো বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন ব্যবসায়ীরা। এমন বাস্তবতায় দেশের রপ্তানি আয়ের বড় এই খাত ঘিরে যেমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তেমনি নানা চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্রয়াদেশ পেতে শুরু করে কারখানাগুলো। কিন্তু উদ্যোক্তারা পোশাক তৈরির জন্য তুলা, সুতা, কাপড়, রাসায়নিকসহ অন্যান্য কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যায় পড়ছেন। আন্তর্জাতিকভাবে কনটেইনারের সঙ্কট ও আকাশচুম্বী ভাড়া, সুতার দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়া, চীনে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে কাঁচামালের ঊর্ধ্বগতি- ইত্যাদি কারণে নিট পোশাকের উৎপাদন খরচ বহু গুণে বেড়ে গেছে।

এতো সঙ্কটের মধ্যেও উদ্যোক্তারা লোকসান দিয়ে হলেও পোশাক রপ্তানি কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। যে কারণে রপ্তানি আদেশ আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী জাহাজ ও কনটেইনার সঙ্কটের কারণে রপ্তানি পণ্য সময়মতো জাহাজীকরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এখনো ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করে রপ্তানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত করছে। ক্ষেত্রবিশেষে মূল্যছাড় দেওয়াসহ নানা শর্ত আরোপ করছে।

করোনার কারণে চীনের অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে বাংলাদেশে আসতে থাকায় আশার আলো দেখেছিলেন এ দেশের পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এখন পর্যাপ্ত অর্ডার থাকলেও কাঁচামালের সঙ্কটের কারণে চাহিদামাফিক পোশাক তৈরি করতে পারছেন না গার্মেন্টস মালিকরা। এতে সামনে অনেক ক্রয়াদেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ বিদেশি ক্রেতারা আন্তর্জাতিক বাজার দেখেই আমাদের পোশাকের মূল্য নির্ধারণ করেন। অন্য দেশে কম দামে পেলে তারা কি আমাদের কাছ থেকে পণ্য কিনবেন?

নিট পোশাকে সুতার ব্যবহার বেশি। সুতার মূল্য প্রধানত তুলার ওপর নির্ভর করে। দেশে বেশির ভাগ তুলা আমদানি হতো উজবেকিস্তান থেকে। কিন্তু তারাই প্রচুর স্পিনিং মিল তৈরি করায় তুলা সেখান থেকে আর তেমন আসছে না। পাশাপাশি চীনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অতিরিক্ত তুলা ও সুতা মজুত করেছে।

নিট পোশাকের বড় এই কাঁচামাল নিয়ে আমাদের এখনই চিন্তা করতে হবে। দেশে তুলা উৎপাদন বাড়ানো বা তুলা আমদানি প্রক্রিয়া সহজিকরণের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

আমাদের তৈরি পোশাকের প্রায় সবই বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হয়। কিন্তু শিপিংয়ে মনোপলি ব্যবসার কারণে জাহাজ ভাড়া, কনটেনার ভাড়া কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। বন্দরকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি কীভাবে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম আরো সহজ করা যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

পোশাকের নিট দামের সঙ্গে যখন অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া, বাড়তি অফডক চার্জ, গাড়ি ভাড়া, স্পিড মানি যুক্ত হয়- তখন আর লাভের মুখ দেখেন না ব্যবসায়ীরা।

নিট কারখানার জন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে সর্বোচ্চ ৩ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। কারণ কাঁচামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে এখন আগের চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানি হলেও তার বিপরীতে ক্রেতারা নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ না দেওয়ায় তারল্য সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। বর্তমান ইডিএফ থেকে সর্বোচ্চ ২ কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন পোশাক শিল্পের মালিকরা। এটি ৩ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়ালে নিট কারখানাগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় শ্রমিকদের মজুরি দিতে প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করে সরকার। সেই তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে দেড় হাজারের বেশি রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের মালিক শ্রমিকদের চার মাসের মজুরি পরিশোধ করেন। পোশাক শিল্পকে বাঁচাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সহায়তা আমাদের সাহস যুগিয়েছে। করোনায় একে একে অর্ডার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা চোখে অন্ধকার দেখছিলেন। সরকার প্রধানের এই সহায়তায় তারা আশার আলো খুঁজে পান।

তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রণোদনার ঋণের অর্থ ফেরত দিতে ব্যবসায়ীদের কিছু সময়ের প্রয়োজন। ঋণের বাকি ১৪ কিস্তি দিতে ৪২ মাস সময় চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে চিঠি দিয়েছে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। আমরা আশা করবো এই বিষয়ে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। নিট পোশাক শিল্প ঘিরে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে- সেটি কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীদের পাশে থাকবে সরকার। সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে তা মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো আমরা।

লেখক: সহ-সভাপতি, বিকেএমইএ

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট