চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

মন্তব্য প্রতিবেদন

অসীম অবদানেও মূল্যায়ন নেই চট্টগ্রামের

ডা. মো. সাজেদুল হাসান

১ জানুয়ারি, ২০২২ | ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

সমুদ্রের কোল আর পাহাড়ে হেলান দেয়া কর্ণফুলী পাড়ের জনপদ চট্টগ্রাম হতে পারতো সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম সুন্দর শহর। প্রাকৃতিক সম্পদ, ভৌগলিক অবস্থান, অনুকূল জলবায়ু সব মিলিয়ে বিধাতার কোনো কার্পণ্য এখানে ছিল না। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অবহেলা, অদক্ষতা, দুর্নীতি, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ আর দূরদর্শিতার অভাবে চট্টগ্রাম আজ তার রানীর মর্যাদা হারিয়েছে। ক্রমাগত অধঃপতনে ¤্রয়িমাণ নগরবাসীকে হয়তো কেউ আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। তবুও কেউ কেউ সমাজ সচেতনতার দায় নিয়ে মাঝে মাঝে সোচ্চার হয়ে উঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম আর দৈনিক পূর্বকোণের ১৩ পর্বের ধারাবাহিক সেই দায়ভারের একটি প্রতিবাদী সংযোজন।
একদা দেশের উত্তরাঞ্চল নিয়ে উন্নয়ন সুবিধাবঞ্চিত আঞ্চলিক বৈষম্যের তকমা সাঁটা ছিল, অর্থনৈতিক অবদানের অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিলে চট্টগ্রামকে এখন অনায়াসে সেই অভিধা দেয়া যায়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই নগরে গড়ে ওঠেনি সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। সুপেয় পানির সরবরাহ, ট্রাফিক সিগন্যাল। স্থাপিত হয়নি পর্যাপ্ত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাবলিক হাসপাতাল, বিনোদনকেন্দ্র, খেলার মাঠ। অথচ এর বিপরীতে চলছে পাহাড়, বৃক্ষ নিধন, নদী দখল আর পরিবেশ দূষণ, সাড়ম্বরে চলছে পায়ে চলার ফুটপাতে দোকান বরাদ্দের মচ্ছব।
কিন্তু এই নগরে পরিকল্পনা আর মহাপরিকল্পনার কমতি নেই। বিদ্যুৎ খাত থেকে শুরু করে জলাবদ্ধতা নিরসন, পয়ঃনিষ্কাশন, ট্রাফিক ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা, যোগাযোগ সবক্ষেত্রেই আছে অশেষ মহাপরিকল্পনা যদিও তার বাস্তবায়ন আর ফলাফল প্রায় শূন্যের কোঠায়। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০ বছর মেয়াদি ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান গ্রহণ করেছিলো যা ২০১৮ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদদের ভাষায় এর ১০ ভাগও যদি সম্পন্ন হতো তাহলেও অনেক পরিবর্তন দৃশ্যমান হতো। তাহলে সমস্যা কোথায়?
অবকাঠামো উন্নয়নে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। এই খাতে বিনিয়োগও হচ্ছে প্রচুর। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে ঘিরে কর্ণফুলী টানেল, রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল, পোর্ট কানেকটিং রোড, বাইপাস, ফ্লাইওভার, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, এলএনজি টার্মিনাল নির্মিত হচ্ছে। কক্সবাজার টেকনাফ পর্যন্ত বর্ধিত হচ্ছে রেল যোগাযোগ। ভবিষ্যতে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জুড়ে এই অবকাঠামো উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক কর্মকা-ের চাপ পড়বে মহানগরীর উপর। নগর কর্তৃপক্ষ কি সেজন্য প্রস্তুত? একবেলা বৃষ্টি হলে এখানে প্রধান সড়কগুলোতে একগলা পানি, জলজট, যানজট, মশার বংশবৃদ্ধি, নালা নর্দমার পানি, মল-মূত্র বর্জ্য মিলেমিশে একাকার, অরক্ষিত ড্রেনে মানুষের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন। তাহলে সিটি কর্পোরেশন আর চট্টগ্রাম ওয়াসার কাজ কী? বছরের পর বছর ধরে প্রকল্প চলমান কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। নাম ওয়াসা মানে ওয়াটার এন্ড স্যুয়ারেজ অথরিটি, নামসর্বস্ব হয়েই থাকবে সারাজীবন। সুপেয় পানি দূরে থাক সংস্থাটি নগরীর সকল অঞ্চলে পানি সরবরাহের কাজটিও এতদিনে সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি।
অথচ কাজগুলো কঠিন হলেও অসম্ভব ছিল না। প্রয়োজন শুধু দূরদর্শী আর সঠিক নেতৃত্বের। নগর কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্ব নাগরিকের উন্নত জীবন স্বচ্ছন্দ করা। চট্টগ্রামের বহু পুরনো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান। বিক্ষিপ্ত উন্নয়ন কর্মকা- দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত সমস্যাগুলোর নিরসন সম্ভব নয়, প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
৫০ বছরের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান নিয়ে এগোতে হবে। থাকতে হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের একটা গাইডলাইন। উন্নয়নের নামে বছরের পর বছর জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে রাখা যাবে না। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সাথে স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সমন্বয় থাকতে হবে যাতে এর সুফল বৃদ্ধি পায়। নগরের সেবাদানকারী সকল সংস্থাকে এক ছাতার নিচে এনে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান প্রণয়নের পূর্বে সকল সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞগণ তথ্য উপাত্ত নিয়ে সপ্তাহব্যাপী রুদ্ধদ্বার কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রকল্প প্রণয়ন করে সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগী দেশি বিদেশি সংস্থার সাথে দেন দরবার করতে হবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কিংবা সিটি কর্পোরেশন এর নেতৃত্বের ভার নিবে। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হবেন সার্বক্ষণিক উপদেষ্টা।
শুধুমাত্র পর্যটনের উপর নির্ভর করে মালদ্বীপ, নেপাল, মরিশাসের মতো দেশ দার্জিলিং, বালির মতো শহর চলছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পর্যটন সম্ভাবনা আর শিল্প-বাণিজ্য বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারতো। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নীতি নির্ধারক, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ সকলকেই এই দায়বোধের অংশীদার হতে হবে।

ডা. মো. সাজেদুল হাসান
সাবেক অতিরিক্ত সচিব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট