চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

গড়ে উঠেনি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

ইফতেখারুল ইসলাম

২২ ডিসেম্বর, ২০২১ | ১:০৫ অপরাহ্ণ

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে (চসিক) গড়ে উঠেনি পরিবেশসম্মত আবর্জনা ব্যবস্থাপনা। মেডিকেল বর্জ্য, ইলেকট্রনিক্স বর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্যে একাকার। নেই কোন স্বাস্থ্যসম্মত ল্যান্ডফিলও। চসিকের দুই আবর্জনার ভাগাড় থেকে চারপাশে গন্ধদূষণ এবং রোগ ব্যাধি ছড়াচ্ছে। একারণে পরিচ্ছন্নকর্মীরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। তবে ৫০ বছর পর কিছু উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে চসিক।
ই-বর্জ্য : সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ই-বর্জ্য। প্রবাসী এবং ব্যবসা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম ই-বর্জ্য উৎপাদনের সবচেয়ে উর্বর জায়গা। কারণ প্রবাসীরা বিদেশ থেকে আসার সময় মোবাইল থেকে শুরু করে নানা ইলেকট্রনিকস পণ্য নিয়ে আসেন। আর বন্দরের কারণে সারা দেশের ইলেকট্রনিকস পণ্য এই শহরের উপর দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় যায়। আলাপকালে পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে সাড়ে ১৩ কোটির বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত লাখ মোবাইল ফোন সেট আমদানি করা হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির তথা মোবাইল সেট, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে, একই সঙ্গে ই-বর্জ্যের পরিমাণও বেড়েছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ই-বর্জ্যে উদ্বেগজনক মাত্রায় বিষাক্ত উপাদান যেমন সিসা, মার্কারি, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, বেরেলিয়াম ইত্যাদি থাকে। এসব বিষাক্ত বস্তু মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, ব্রেইন, হার্ট ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইকো সিস্টেম নষ্ট করে। চলকি বছর ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ প্রণয়ন করেছে সরকার। গত ১০ জুন বিধিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। বিধিমালার কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)’ এর ১৫ (১) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে।
মেডিকেল বর্জ্য : জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত মেডিকেল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্য উন্মুক্তভাবেই আবর্জনার ভাগাড়ে ফেলা হয়। অথচ স্বাস্থ্যসম্মতভাবে এসব বর্জ্য ফেলতে হলে প্রথমেই অটোক্লেভস অথবা ইটিপি’র মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করার নিয়ম রয়েছে। চসিক একটি অনভিজ্ঞ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মেডিকেল আবর্জনা সংগ্রহ করে। ‘সেবা সংস্থা’ নামের এই প্রতিষ্ঠানকে সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করেছে। তাদের নেই দক্ষ জনবল, নেই ইনসিনারেটর মেশিন।
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ : গত আট বছর ধরে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে চসিক অন্তত দুই ডজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছিল। এমনকি পিডিবি’র সাথে চুক্তি করেছিল। সফল হয়নি। এবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও বিদ্যুৎ বিভাগের উদ্যোগে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বপ্ন দেখছে চসিক। এসংক্রান্ত ফাইলটি বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি মন্ত্রণালয়ে আছে। অনুমতি পেলে আবারো কোন বেসরকারি সংস্থার সাথে চুক্তি করতে পারবে।
বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : হালিশহরে প্রতিদিন ৫০০ কেজি সিটি জৈব সার উৎপাদন হয়। কেজি ১৬ টাকায় এই সার বিক্রি করা হয়। এছাড়া হালিশহরে একটি পিকা ¯স্লাইস ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে ৪৮ হাজার লিটার মানববর্জ্য পরিশোধন করে সারে পরিণত করা যায়। আরেফিন নগরে আরেকটি একই ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে প্রতি মাসে চার লাখ ৪০ হাজার মানববর্জ্য পরিশোধন করা সম্ভব।
নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডকে কনজার্ভেন্সি ওয়ার্ড ঘোষণা করা হলেও ডোর টু ডোর কার্যক্রমে এখনো শতভাগ সফলতা আসেনি চসিকের। পরিচ্ছন্ন বিভাগের প্রধানের দাবি তাদের সফলতা ৯০ শতাংশ। আবর্জনাবাহী ট্রাকসমূহ এলাকাভিত্তিক ময়লা সংগ্রহ করে আরেফিন নগর এবং হালিশহরস্থ ডার্ম্পি ইয়ার্ডে ফেলে আসে। প্রয়োজনীয় ভ্যানের অভাবে শতভাগ নগরবাসীকে এই কার্যক্রমের আওতায় আনা যায়নি। রয়েছে লোকবল সংকটও।
এবিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোশেদ আলম চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, পরিচ্ছন্ন কর্মীরাই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করছেন একথা সত্য। তবে নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। কোন বাড়ি থেকে কোন কারণে আবর্জনা সংগ্রহ করা না গেলে রাস্তায় ফেলা যাবে না। বাসায় সংরক্ষণ করতে হবে। পরদিন পরিচ্ছন্ন কর্মীর গাড়িতে তা দিতে হবে। এই শহরে দৈনিক ২৫০০ টন আবর্জনা উৎপাদন হয়। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ অপসারণ করার দাবি করে বলেন, এই শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে সেকেন্ডারি টেনজিং স্টেশন প্রয়োজন। যা এখনো পরিপূর্ণভাবে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। আবর্জনা ফেলার জন্য এখানে কোন ল্যান্ডফিলও নেই। ল্যান্ডফিল হল শহরের বাইরে বিশাল একটি গর্ত খুঁড়ে ওই গর্তে ময়লা ফেলা। গন্ধ যেন বাতাসের মাধ্যমে দূরে ছড়াতে না পারে। পরিচ্ছন্ন বিভাগের কাজ তদারকের জন্য পর্যাপ্ত সুপারভাইজারও নেই।
বর্জ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যানের বক্তব্য : কাউন্সিলর মোবারক আলী পূর্বকোণকে বলেন, অতীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন হয়নি একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে বর্তমান মেয়রের নেতৃত্বে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। মেডিকেল বর্জ্য অপসারণের জন্য ইনসিনারেটর মেশিন আনা হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রা. সার্ভিস নামে একটি বেসরকারি সংস্থার সাথে চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ওই সংস্থার মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহ করা হবে আধুনিক পদ্ধতিতে। তবে এখনো চুক্তি হয়নি উল্লেখ করে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের চিন্তা-ভাবনা হল প্রথমে একটি ওয়ার্ডে ওই সংস্থাকে বর্জ্য সংগ্রহের সুযোগ দেয়া। ৬ মাস তাদের পর্যবেক্ষণ করে বাকি ৪১ ওয়ার্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি জানান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের আওতায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের লোকবল এবং পরিবহনের মাধ্যমে বাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কমিউিনিটি সেন্টার, শিল্প কারখানা হতে অক্ষতিকর বর্জ্য সংগ্রহ করবে। যে চুক্তি করা হবে, চসিক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে নিজস্ব পরিবহনে পৌঁছে দিতে হবে। বর্জ্য কালো রং এর গার্বেজ ব্যাগ মুড়িয়ে উৎসস্থল থেকে সংগ্রহ করতে হবে। থ্রি-আর পদ্ধতিতে সংগৃহীত বর্জ্য হতে পুনঃব্যবহারযোগ্য ও পুনঃপ্রক্রিয়াযোগ্য পণ্য আলাদা করবে। জৈব এবং অজৈব বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করবে। প্রতি ফ্ল্যাট, সেমিপাকা ঘর, দোকান, কমিউনিটি সেন্টারসহ প্রত্যেক সেবাগ্রহিতার কাছ থেকে মাসিক ফি আদায় করা হবে। তবে রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমার ঝাড়– ও আবর্জনা সংগ্রহ করবে সিটি কর্পোরেশন। বেসরকারি সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব লগোর সাথে চসিকের লগোও ব্যবহার করতে পারবে।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট