চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

চাপ বাড়বে জীবনযাত্রায়

মিজানুর রহমান 

৫ নভেম্বর, ২০২১ | ১২:৪৬ অপরাহ্ণ

করোনার ধাক্কায় আয় কমেছে ৭৭ শতাংশ মানুষের। বিপরীতে লকডাউন পরবর্তী সময়ে বেড়েছে প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম। একদিকে আয় কমেছে। অন্যদিকে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সবমিলিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে এমনিতেই কষ্টে ছিলেন মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পর্যায়ের মানুষ। এরমধ্যেই ডিজেল, কেরোসিন এবং এলপিজির দাম বাড়ানোর ঘোষণা এসব মানুষের জন্য ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কারণ হিসেবে তারা বলছেন- প্রায় সব যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ডিজেল। ডিজেলের দাম বাড়ায় এখন পণ্য ও যাত্রী পরিবহন ভাড়া বাড়বে। সেচের পাম্পে ডিজেল ব্যবহৃত হওয়ায় বাড়বে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচও। কেরোসিনের দাম বাড়ায় আলো জ্বালাতে খরচ বাড়বে বিদ্যুৎহীন এলাকার মানুষের। এলপিজির বাড়তি দামের কারণে বেশি খরচ হবে বাসা-হোটেলের রান্নায়। সিএনজি চালিত গাড়িতে।

গত বুধবার ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৬৫ টাকা থেকে এক লাফে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। পরেরদিন বৃহস্পতিবার এলপিজির দাম কেজিতে সাড়ে ৪ টাকা হারে বাড়িয়ে ১০৬ টাকা ১৯ পয়সা করা হয়। বাড়ানো হয় পরিবহনে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের দামও। চলতি নভেম্বর মাসের জন্য প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম ৫৮ দশমিক ৬৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬১ দশমিক ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

দেশে কোনো পণ্যের দাম কমানোর পর তা কার্যকরে দীর্ঘ সময় লাগে। তবে বরাবরের মতো ডিজেল, কেরোসিন এবং এলপিজির দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে না আসতেই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কোথাও কোথাও গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে যাত্রীদের কাছ থেকে। পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে আজ শুক্রবার থেকে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান- সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা না করে হঠাৎ ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বাড়ানোয় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বাড়ায় দেশের বাজারে দাম বাড়ানো হয়েছে- সরকারের এই দাবি যৌক্তিক নয় বলেও মনে করছেন তারা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন- বিপিসি এখন যেসব ডিজেল বিক্রি করছে তা কয়েকমাস আগে কেনা। বাড়তি দামে এখনও কোনো ডিজেল কেনা হয়নি।

জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা প্রফেসর এম শামসুল আলম পূর্বকোণকে বলেন, আইন অনুযায়ী জ্বালানি বিষয়ক সবকিছুর দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি। কিন্তু ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই আইন মানা হয়নি। যারা আইন না মেনে দাম বাড়িয়েছে তারা অপরাধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কারাদ-, অর্থদ- বা উভয়দ-ও হতে পারে তাদের।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়লে এর প্রভাব আমাদের বাজারে পড়তে দেড়-দুই মাস লাগে। আমরা ডিজেল বা কেরোসিনের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেটা বিবেচনায় নিইনি। এলপিজির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রেও সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কারণ ছাড়াই ভোক্তাদের কাছ থেকে দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। এতে কেবল অসাধু ব্যবসায়ীরাই লাভবান হচ্ছে। তাদের লাভ করিয়ে দিতে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।

‘সরকারের লক্ষ্য জনকল্যাণে কাজ করা। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা যদি এভাবে জনগণের স্বার্থ বিপন্ন করে কাজ করেন, সিদ্ধান্ত নেন- তাহলে সরকারের সেই লক্ষ্য পূরণ হয় না। তাদের উচিত ছিলো- দাম বাড়ানোর ক্ষমতা যে তাদের নেই সেটা সরকারকে জানানো। কিন্তু তারা সবকিছু সরকারকে না জানিয়ে গোপনে গোপনে দাম বাড়িয়েছে। এটা কার স্বার্থে?’ প্রশ্ন তোলেন দেশের খ্যাতিমান এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।

 

লুটপাটের জন্যই দাম বৃদ্ধি

আনু মুহাম্মদ

অর্থনীতিবিদ

ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এসব জ্বালানির দাম যত শতাংশ বাড়ানো হয়েছে- তার চেয়ে কয়েকগুণ বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়। কারণ পণ্য পরিবহন ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এখন চাপ আরও বাড়বে।

যারা এসব কিছু (দাম বৃদ্ধি) নিয়ন্ত্রণ করে, তারা এখন যা খুশি তাই করতে পারে। এ সমস্ত ক্ষেত্রে তো আর সরকার নেই। এ কারণে ডিজেল, কেরোসিন বা এলপিজির দাম সরকার যত শতাংশ বাড়াবে, তার চেয়ে বেশি শতাংশ মানুষের কাছ থেকে আদায় করা হবে। সবকিছুতে চাপ পড়বে।

সরকার এসব করছে টাকা তোলার জন্য। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যে দুর্নীতি হয়-যে লুটপাট হয়, তা তো মানুষের ঘাড় থেকে নিতে হবে। এসব টাকা আসবে কোত্থেকে। মানুষের কাছ থেকেই তো নিতে হবে। সুতরাং কদিন পর পর নানান কিছুর দাম বাড়িয়ে টাকা তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

 

নির্বুদ্ধিতার মতো কাজ হলো

এম শামসুল আলম

জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব

করোনাকালে ৭৭ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। বিপরীতে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এই অবস্থায় তেলের দাম শুধু লিটারে ১৫ টাকা বাড়লো তা না- এর কারণে ভাড়া বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে।

পণ্য কেনার ক্ষমতা কমে যাবে। তারা ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করবে। এতে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমে যাবে। ভ্যাট, ট্যাক্স কালেকশন কমে যাবে। সরকার বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে যেটা অর্জন করতে পারবে না। বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাবে।

ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে লোন নেবে। সরকার লোন নিলে প্রাইভেট সেক্টরের ইনভেস্টমেন্ট কমে যাবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমবে। অর্থাৎ নেতিবাচক প্রভাব সবখানে বিদ্যমান হবে। বিপিসির কিছু টাকা বাঁচাতে চারদিকের যে ক্ষতি- এটার হিসাব জ্বালানি বিভাগের থাকা জরুরি ছিলো। এখন বিপিসির ঘাটতি মেটাতে গিয়ে আমরা নির্বুদ্ধিতার মতো কাজ করলাম।

 

 

গরিবরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বেশি
ড. মো. আলী আশরাফ
অধ্যাপক, চবি

ডিজেল, কেরোসিন এবং এলপিজির দাম বাড়ানোর প্রভাব প্রতিটি খাতেই পড়বে। তবে গরিবরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বেশি। কারণ এসবের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বাড়বে। এর সুযোগ নিয়ে পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচ যা বাড়বে, তার চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি হবে।
নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে- ভারতে তেল পাচার হয়ে যাবে এ কারণে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এসব মুখরোচক কথা। সবার আয় বেড়েছে, সবাই ভালো অবস্থানে আছে- এটাও ঠিক নয়। উপরের দিকে ৪-৫টা গ্রেডের কিছু লোকজন হয়তো ভালো আছে। কিন্তু বাকিদের অবস্থা ভালো না।
ডিজেল, কেরোসিন মধ্যবিত্ত-নি¤œবিত্তরা বেশি ব্যবহার করেন। সরকার এসবের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু অকটেন, পেট্রোল- এসবের দাম বাড়ানো হয়নি। কারণ যারা সিদ্ধান্ত নেন, তারা এসব ব্যবহার করেন। নতুন গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এরমধ্যে সিলিন্ডারের দাম বাড়ালে মানুষ যাবে কোথায়?

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন