চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

বুকে এখনো কম্পন সৃষ্টি হয়, অসাড় হয়ে ওঠে শরীর

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

২২ অক্টোবর, ২০২১ | ২:০৪ অপরাহ্ণ

২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি। সকাল সাড়ে ৮টা কিংবা ৯টা। তখনো বিছানায়, ঘুমে। ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর গগণবিদারী কান্নায় ঘুম ভাঙে। ছোট ভাই চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় …। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। ভাইয়ের মোবাইলে ফোন দিলাম। ওই প্রান্ত থেকে জানাল, এই চরম দুঃসংবাদ। আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। উপায়ন্তর না দেখে কল দিলাম কাছের বন্ধু সাংবাদিক শাহীনূর কিবরীয়া মাসুককে। চকরিয়া যেতে হবে। মাইক্রোবাস ঠিক করলাম। এরইমধ্যে পাড়া-পড়শি, আত্মীয়স্বজনের ভিড় পড়ে গেল। চারদিকে কান্নার রোল।  ভাইয়ের মোবাইলে ওই ব্যক্তি বললেন, মামুন নামে এক ব্যক্তি মারা গেছে। আর দুইজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। আল্লাহপাকের কাছে ভাইয়ের জীবন ভিক্ষা ছাড়া আর কোনো প্রার্থনা ছিল না।

সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ছোট ভাই জসিম উদ্দিনকে আনা হচ্ছে চট্টগ্রামে। চকরিয়া পুলিশ মোবাইল ও তার সঙ্গে থাকা প্রায় আড়াই-তিন লাখ টাকাসহ এক ব্যক্তিকে দিয়ে চট্টগ্রামে পাঠালেন। অপেক্ষার প্রহর গুনছি। আর আল্লাহপাকের কাছে ভাইয়ের জীবন-ভিক্ষা প্রার্থনা করছি। পটিয়ার বাদামতল এলাকায় ভাইয়ের রক্তাক্ত চেহারা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। এম্বুলেন্স ছুটছে চমেক হাসপাতালে। সেখানে আগ থেকেই প্রস্তুত ছিলেন চমেক হাসপাতালের জাকির ভাই (পূর্বকোণের সহকর্মী)। প্রতিবেশী ও পরিচিত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. সীমান্ত ওয়াদ্দেদারসহ আরও কয়েকজন চিকিৎসক।

দীর্ঘক্ষণ অপারেশনের পর ভাইকে বের করা হল। আমাকে কাছে যেতে দিচ্ছেন না স্বজন ও বন্ধুরা। ভাইয়ের অবস্থা সংকটাপন্ন। চিকিৎসক, স্বজন ও বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন, প্রখ্যাত নিউরোলজি সার্জন প্রফেসর ডা. কামাল উদ্দিনের শরণাপন্ন হওয়ার। মুহূর্তের জন্য তা ছিল খুবই কঠিন। ফোন দিলাম আমাদের পূর্বকোণের বর্তমান সম্পাদক ডা. ম. রমিজ উদ্দিন চৌধুরীর কাছে। তাঁর ফোনে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে ছুটে আসলেন প্রফেসর ডা. কামাল উদ্দিন। ভাই তখন আইসিইউতে। আশা-নিরাশার বাণী শোনালেন তিনি। আমাদের সম্পাদকের (ডা. ম. রমিজ উদ্দিন চৌধুরী) উদার সহায়তায় আইসিইউতে চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের নিরলস-অক্লান্ত সেবায় শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে ছিল। দীর্ঘদিন থাকতে হয় হাসপাতালে।

সেই দুর্ঘটনায় মারা যায় আবদুল মামুন। ভাইয়ের বাল্যবন্ধু। পরে শ্যালিকার জামাই। দু’জন ছিল মানিকজোড়। ভাইয়ের জ্ঞান ফেরা ও শারীরিক উন্নতির পর তার খবর নিচ্ছেন বার বার। বলতাম সে বেঁচে আছে, চিকিৎসা চলছে। খরচাপতি দিচ্ছি। আরেক সঙ্গী বদি আলমের কথাও জানতে চাচ্ছে। বদি দুইদিন পর মারা গেল। সেও বেঁচে আছে বলতাম। স্বার্থপরের মতো ভাইয়ের জন্য মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। চিকিৎসকদের পরামর্শও তা ছিল।

গরু কেনার জন্য চকরিয়ায় গিয়েছিল ছোট ভাই জসিম উদ্দিন। সঙ্গে ছিল তার দুই বন্ধু। সিএনজি-ম্যাজিক গাড়ির সংঘর্ষ হয়েছিল। তিনজনের মধ্যে দুইজন মারা যান। ভাইয়ের কাছে তাদের মৃত্যু সংবাদটি প্রায় তিন মাস চেপে রেখেছিলাম।

ভাইয়ের রক্তমাখা সেই ছবিটি এখনো মোবাইলে সংরক্ষিত রয়েছে। সেই চেহারা মনে পড়লে হৃদয়ে এখনো রক্তক্ষরণ হয়। বুকে কম্পন সৃষ্টি হয়। শরীর অসাড় হয়ে ওঠে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট