চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শূন্য থেকে সাফল্যের শিখরে

নুরুল আলম

২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ২:১৩ অপরাহ্ণ

দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আলহাজ মরহুম ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন একজন সত্যিকারের মানবদরদী এবং আধুনিক চট্টগ্রামের স্বপ্নদ্রষ্টা। একাগ্রতা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও সততায় তিনি শূন্য থেকে পৌঁছেছিলেন সাফল্যের শিখরে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এবং সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেন। ছোট বা বড়, নিজের হোক বা অন্যের, যেকোন কাজকেই তিনি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতেন। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।

চট্টলদরদী ইউসুফ চাচার সাথে আমার পরিচয় অনেক পুরোনো হলেও ঘনিষ্ঠতা বেশি হয় ২০০০ সালের দিকে। একজন প্রকৃত মানবদরদী মানুষ ছিলেন তিনি। আমার ব্যক্তিগত জীবনেও রয়েছে তাঁর অনেক অবদান ও স্মৃতি। সবেমাত্র ২৫তম বিসিএস পরীক্ষায় পাস করেছে আমার ডাক্তার ছেলে। চেয়েছিলাম আমার নিজবাড়ি সাতকানিয়া মেডিকেলে পোস্টিং নিয়ে দিতে; যাতে করে আমার নিজের গ্রামের মানুষের সেবা করতে পারে। তৎকালীন সিভিল সার্জন খুরশীদ জামিলও আমার বন্ধু। তাকে অনুরোধ করতেই জানাল ছেলের স্থায়ী ও অস্থায়ী ঠিকানা দুটোই যেহেতু চট্টগ্রাম শহরে, সাতকানিয়ায় পোস্টিং দেয়া সম্ভব নয়। মন খারাপ নিয়ে এলাম পূর্বকোণ অফিসে।

ইউসুফ চাচা আমাকে দেখতেই বলে উঠলেন, নুরুল তোমার মন ভাল নেই কেন? কীভাবে যেন মানুষের মনের ভিতরটা জেনে ফেলতেন তিনি। ঘটনাটা খুলে বললাম। আরো জানালাম, ছেলে কাল সকালে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে বর্তমান কর্মস্থলে চলে যাবে। ফিরে গেলাম বাসায়। রাত ১১টায় আমার ল্যান্ডফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে চাচা জানালেন, তোমার ছেলেকে কাল ঢাকায় যেতে বারণ কর, সকাল ১০টায় যেন আমার অফিসে আসে। পরদিন ছেলে চাচার কার্ড নিয়ে সিভিল সার্জন অফিসে গেল এবং পোস্টিংও পেয়ে গেল। কিন্তু সবচেয়ে অবাক বিষয় ছিল, চাচার কাছে আমার নম্বর ছিল না। তিনি রাত এগারটায় শুধুমাত্র ফোন করার জন্য বাসা থেকে অফিসে আসেন এবং অফিস থেকে বাসার নম্বর বের করে নিয়ে আমাকে ফোন করেন।

কোন কাজ বা সমস্যা উনার মস্তিষ্কে ঢুকে গেলে সেটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিনি থামতেন না। শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, এরকম আরো হাজারো প্রমাণ আমি দেখেছি যে, তিনি কতটা দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করতেন। উনার সাথে আমার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সেসব জায়গায় দেখেছি, তিনি কীভাবে মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিতেন।

এখন খাদ্যপণ্যে ভেজালবিরোধী আন্দোলনে সামিল সবাই। অথচ অনেক আগে থেকেই খাদ্যে ভেজাল নিয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। দুধে ভেজাল দিয়ে কীভাবে মানুষের ক্ষতি করছে, সেটা নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকতেন। ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের প্রতিটি সভায় এ নিয়ে সোচ্চার থাকতেন তিনি।

তাঁর প্রতিটি কথা এখনও আমার জীবনের দিক-নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতিপ্রেমীও ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম শহরে একবার সিআরবিসহ বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় শিশু গাছ অকারণে মরে যাওয়ার খবর দিলাম উনাকে। খবর পেতেই পূর্বকোণ থেকে এজাজ ইউসুফীকে নিয়ে ছুটলেন গাছ দেখতে। ফিরে এসে ফলাও করে সংবাদ প্রচার করেই থামলেন না, সকলের সহযোগিতা নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিলেন সে গাছ রক্ষায়। ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে তিনি ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। সে সময় অনেকেই বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়, আর তারই ফলশ্রুতিতে আজ প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে থাকতেন সবার আগে। একসময় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওয়াসার বিলে ছিল চরম বৈষম্য। তিনি মানববন্ধনসহ নানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সে বিল বৈষম্য কমিয়ে আনেন। এরকম হাজারো কাজে তাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে আমি দেখেছি।

নিউজ পেপারের জন্য বন্ডের কাগজ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নয়ছয় হয়। অথচ আমি এক ব্যাংকারের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম, জীবদ্দশায় অতিরিক্ত এক রিম কাগজের ডিউটি ফ্রি সুবিধা তিনি নেননি। কাউকে সময় দিয়ে তিনি কখনো একমিনিট বসিয়ে রাখেননি। বরং পাঁচমিনিট আগেই চলে যেতেন।

ইউসুফ চৌধুরী হিসেবে গড়ে উঠার পিছনে তাঁর কঠোর পরিশ্রম এবং কঠিন সময়ের বেশ কিছু কথা আমাকে বলেছেন। এরকম একটি ঘটনা বললে বোঝা যাবে, তার এ অর্জনের পিছনে কতটা পরিশ্রম ছিল। টাকার অভাবে এসএসসি পাস করে কোন কলেজে ভর্তি হতে পারছিলেন না। ভর্তির সময়ও শেষ হয়ে আসছে।

কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু কানুনগোপাড়া কলেজে ভর্তি হয়েছে। একদিন সকাল বেলা উঠে খালি পেটে পায়ে হেঁটেই চলে যান সেখানে। বন্ধুরা নিয়ে গেলেন অধ্যক্ষের কাছে, সমস্যার কথা বললেন। অধ্যক্ষ উনাকে সময় দিলেন এবং পরে সে সুযোগে তিনিও ভর্তি হলেন। শিক্ষাকে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। সাতকানিয়ায় আমি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। যখন এসব প্রতিষ্ঠানে তাঁকে দাওয়াত দিয়েছি, কখনো না করেননি। উৎসাহ দিয়েছেন, বলেছেন শিক্ষা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।

২০০৭ সালে আমি অস্ট্রেলিয়া সফরে যাই। ওখানে গিয়ে উনাকে ফোন দিতেই বললেন শাহেদ কাদেরী আজ মারা গেছেন। দেখলাম উনি বেশ হতাশ হয়ে পড়েছেন। এর ১৫ দিন পর পরিচিত একজনের থেকে ফোনে পেলাম সেই দুঃসংবাদ। চট্টগ্রামবাসীকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন মানবদরদী ইউসুফ চৌধুরী।

দেশে ফিরে আমি সৌদি আরবে ওমরা হজে গিয়ে খুঁজতে লাগলাম আমার সে প্রিয় মানুষটির কবরস্থান। ওখানে কবরকে সেভাবে চিহ্নিত করা যায় না। তবু ঘুরে ঘুরে কবর জিয়ারত করলাম আর আল্লাহর কাছে তার জন্য প্রার্থনা জানালাম। পৃথিবীতে যুগে যুগে এমন কিছু মানুষ আসে, জীবদ্দশায় যাদের কাজ-কর্ম, ধ্যান-ধারণা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকে। আল্লাহর রহমতে তাঁর মৃত্যু ও কবর দুটোই মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থানে।

লেখক:  বিশিষ্ট ব্যবসায়ী

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট