চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তিনি আজ শতবর্ষী হতেন…

শিশির দত্ত

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ২:১৬ অপরাহ্ণ

তিনি বেঁচে থাকলে আজ শতবর্ষী হতেন। তাঁকে যেভাবে দেখেছি, যতটা জেনেছি, তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ছিল ‘দৈনিক পূর্বকোণ’। একটি আধুনিক কাগজ করার ক্ষেত্রে তিনি একটি বড় সময় প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এই প্রস্তুতি পর্বে নানারকমভাবে নানা ধরনের উদ্যোগ ছিল তাঁর। প্রতি মুহূর্তে তিনি ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ প্রকাশের আগে থেকেই আগেও যেমন এবং প্রকাশের পরও প্রতি মুহূর্তে নতুন ভাবনা-চিন্তার মধ্য দিয়ে পূর্বকোণকে নিয়ে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। এই প্রস্তুতি পর্বেই একটা বড় সময় তাঁর সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। মুদ্রণ শিল্পের সৌকর্য তৈরিতে তাঁর অবদান অপরিসীম। ‘দোলনা প্রকাশনী’, ‘সিগনেট প্রেস’, ‘নিউজ ফ্রন্ট’, ‘সিগনেট বক্স’, ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ এসব কিছুর ভেতরেই তাঁর উদ্ভাবন ও রুচিশীলতার একটা ব্যাপক পরিচিতি আমরা খুঁজে পাই যেটা সবসময়ই কোন না কোনভাবে আমাদের উৎসাহিত করেছে।

সেল্ফমেইড মানুষ বলতে যা বোঝায় আসলেই তিনি তা-ই। তিনি নিজেই অনেক কিছু করেছেন। ছোট ব্যবসা থেকে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যে ক্ষমতা, তা তিনি দেখিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ইউসুফ চৌধুরীর সমগ্র একাগ্রতা সীমাবদ্ধ ছিল শিক্ষার ক্ষেত্রে। আধুনিক শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের পরিচয় আমরা তাঁর ৮৬ বছরের জীবনের কর্মকাণ্ডে বিভিন্নভাবে পেয়েছি। এই শিক্ষার প্রতি তাঁর ভিতরকার যে অনুপ্রেরণা, তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুণী মানুষের সান্নিধ্যে এসে তাঁর ভেতর তৈরি করতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কবি নজরুলকে দেখেছিলেন। এই দেখা কেবলমাত্র দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। নজরুলের আদর্শিক ভাবনা তখন থেকেই তাঁকে প্রভাবিত করেছে; যা তাঁর ভাবনায় নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। যেখানে ছিল মানুষের প্রতি তাঁর ভাললাগা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে অঁজো পাড়াগাঁয়ে লাইব্রেরি গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা তিনি নিয়েছিলেন, এতেই শিক্ষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ও দৃষ্টিভঙ্গি আমরা আঁচ করতে পারি। এ অঞ্চলের বাঙালিদের শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নিউজ ফ্রন্ট’। কত আগেই এমন একটি আধুনিক নামের কথা তিনি চিন্তা করতে পেরেছিলেন! তৎকালীন সময়ে মাত্র ছয়টি স্টেট্স্্ম্যান কাগজ তিনি কলকাতা থেকে আনতেন। তাঁর তিনটি কাগজের গ্রাহক ছিলেন জেমস ফিনলের দুই সাহেব, অপরজন ছিলেন ন্যাশনাল গ্রিনলেজ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন বিদেশি কর্মকর্তা, অপর তিনজন ব্যারিস্টার রফিক উদ্দীন সিদ্দীকি, এডভোকেট কে.পি. নন্দী এবং ও আর নিজাম। পরবর্তীতে ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব পাকিস্তান’, ‘ডন’ পত্রিকার এজেন্সি তিনি নিয়েছিলেন। তিনিই চট্টগ্রামে প্রথম বিদেশি ইংরেজি বই আমদানি করেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের ইংরেজি পাঠকের হাতে ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ এর মতো পত্রিকা তিনি তুলে দিয়েছেন। এভাবেই এ অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।

তাঁর মুখ থেকেই শোনা, যৌবনে তিনি প্রচুর চলচ্চিত্র দেখেছেন, ছবি দেখেছেন। তৎকালীন খুরশীদ মহল ছিল তাঁর সিনেমা দেখার অন্যতম ভাল লাগার জায়গা। এই আধুনিক মানুষটি বইপত্র, পত্রিকা বিক্রির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ১৯৮৬ সালে তাঁর হাত দিয়েই চট্টগ্রামের আধুনিক পত্রিকা ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ প্রকাশিত হয়। এ আধুনিক নামটি আনিসুজ্জামান স্যারের দেওয়া। আবুল মোমেন এবং আমি এই নামটি যখন তাঁর কাছে প্রস্তাব করি, অনেকগুলো নামের ভেতর থেকে এ নামটিকেই তিনি সর্বাগ্রে গ্রহণ করেন। এর মধ্যে তাঁর অনেকগুলো ছোট ছোট প্রস্তুতি ছিল। তখনকার সময়ে ফটো অফসেটে প্রকাশের যন্ত্র তিনি ‘সিগনেট প্রেস’ এ স্থাপন করেছিলেন। এর আগে স্বাধীনতার পরে তিনি একটি কাগজ করার চেষ্টা করেছিলেন, তাতে সফল হতে পারেননি। পূর্বকোণের ডিক্লারেশন পাওয়ার সময় আমার ইউসুফ চৌধুরীর (চাচার) সাথে অনেক সময় কেটেছে। তখন একটি কাগজের ডিক্লারেশন পাওয়া সহজসাধ্য ছিল না। সেই সময়ের নানা প্রতিকূলতাকে তিনি ক্রমে ক্রমে অতিক্রম করেছিলেন। এই সময়টায় তাঁর খুব কাছে ছিলাম। সেই সময়ে তাঁর অপরিসীম ধৈর্য্য ও আমাদেরকে স্বস্তি-সান্ত¦না দেওয়ার তাঁর যে প্রক্রিয়া সেটি আমাদের কাছে এক বিরল পাওয়া। সেখানেই তাঁর পরিশ্রম, উদ্যমী ভূমিকা আমাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। পত্রিকা প্রকাশ করেই তিনি যে তাঁর উদ্যমগুলো থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন, তা নয়। তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রায় সত্তরোর্ধ্ব বয়সে চট্টগ্রামের লোকদের জন্য ‘ডেইরি ও পোল্ট্রি’ আন্দোলন। সেক্ষেত্রে তিনি তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। পাশাপাশি চট্টগ্রামে ‘ভেটেরিনারি এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আন্দোলন এবং তা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর চট্টগ্রামের প্রতি এই ভালবাসা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।

আজ তিনি শতবর্ষী হতেন। একজন স্বপ্নসফল মানুষ। যদি শতবর্ষী হতেন তাহলে তাঁর কাছ থেকে আমরা আরও কিছু উদ্ভাবন পেতাম, যেখানে আমাদের সমাজজীবনের অনেক ইতিবাচকতার হয়তো প্রকাশ হতো। আমি মনে করি, তিনি জীবদ্দশায় প্রকৃত সম্মান পাননি। তাঁকে এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো জরুরি। এতে করে চট্টগ্রামবাসীর দায়মুক্তি ঘটবে।
ইউসুফ চৌধুরীর অবদান কেবল চট্টগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বলা যায় কোন না কোনভাবে সমগ্র দেশ তাঁর অবদানে উপকৃত হয়েছে। তিনি ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে যেভাবে ভূমিকা রেখেছেন, তা নিঃসন্দেহে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে।

লেখক: সাংস্কৃতিক কর্মী

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট