চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের এক বছর: সিএমপির অন্যরকম মানবতা

এ.এ.এম হুমায়ুন কবীর পিপিএম 

৮ মার্চ, ২০২১ | ১:০৯ অপরাহ্ণ

আইইডিসিআর এর তথ্যমতে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে মানবদেহে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে । এসময় নগরীর প্রতিটি গলিতে করোনা প্রতিরোধে কাজ করেছে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিনট পুলিশ (সিএমপি)। কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন সিএমপি’র ৭১৪ জন। এখনো ১২ জন করোনাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। মহামারীতে নিহত হয়েছেন সাত পুলিশ সদস্য। প্রতিষ্ঠান কিংবা বাড়ি লকডাউন ঘোষিত হলে তা নিশ্চিত করা, বিদেশ ফেরত কিংবা অন্যভাবে কোয়ারেন্টিইনে থাকা মানুষকে ঘরে থাকা নিশ্চিত করা, আইসোলেশন নিশ্চিত করা, অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে প্রেরণ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, গর্ভবতী মহিলাদের হাসপাতালে আনা-নেয়া, চিকিৎসক ও চিকিৎসার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে বাসস্থান হতে হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছানো, অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে ওষুধ  ও খাবার সামগ্রী পৌঁছানো, ত্রাণ বিতরণ, নিজস্ব উদ্যোগে টেলি মেডিসিন সেবা, করোনাক্রান্ত মৃত ব্যক্তির লাশ পরিবহন ও যথাযথ মর্যাদায় দাফনের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত সদস্যরা। এছাড়াও ঘরে থাকা কর্মহীন দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে রাতের অন্ধকারে দরজায় নক করে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে পুলিশ।

মহানগর এলাকায় করোনাভাইরাসের তান্ডব মোকাবিলায় প্রায় সাত হাজার ফোর্সের পুলিশ বাহিনীর কাপ্তান হলেন পুলিশ কমিশনার। সহযোদ্ধা হিসাবে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছেন তিনজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারসহ চারটি অপরাধ বিভাগ, দুটি মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ, দুটি ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, সহকারী পুলিশ কমিশনার এবং ১৬টি থানার অফিসার ইনচার্জবৃন্দ। কর্মী হিসাবে কাজ করছেন প্রায় ৭০০০ হাজার জনবলের অসংখ্য টিম। করোনার ভয়াবহ রূপ আঁচ করতে পেরে পুলিশ কমিশনার বিনোদন কেন্দ্র  ও পর্যটন স্পট পতেঙ্গায় জনসমাগম নিষিদ্ধ করেন। হোটেল, মোটেল, ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টারের সকল কার্যক্রম স্থগিত ছিল। এরপর ধীরে ধীরে পুরো মহানগর এলাকা লকডাউন করে দেন। মহানগরের প্রবেশমুখে স্থাপন করেন পুলিশ চেকপোস্ট।

খোলা মাঠে কাঁচাবাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর দোকান বসিয়ে জনগণের সুবিধা নিশ্চিত করার মত কাজ করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। রেখেছিলেন প্রবেশমুখী হাত ধোয়ার জন্য সাবান পানির ব্যবস্থা।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ৮০টি  মোবাইল টিম ২৪ ঘণ্টা মাঠে থেকেছে। এছাড়াও ছিল ফুট পেট্রোল। ট্রাফিক বিভাগসহ প্রতিটি থানা হতে ৪/৬টি হোন্ডা মোবাইল টিম সার্বক্ষণিক টহল দিয়েছে প্রতিটি অলি-গলি,পাড়া-মহল্লায়। বিট পুলিশিং অফিসারগণ কাজ করছেন প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অন্যতম একটি উদ্যোগ “করোনা ভাইরাস রেসপন্স টিম” গঠন করা। মহানগর এলাকায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পুলিশ ও জনসাধারণকে জরুরি সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সিনিয়র একজন পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে “করোনাভাইরাস রেসপন্স টিম”। ২টি এম্বুলেন্স  ও অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামসহ সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থেকে করোনাক্রান্ত ব্যক্তির সংবাদ পেলে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানসহ আইসোলেশন কিংবা হাসপাতালে প্রেরণের ব্যবস্থা করে যাচ্ছিল এ টিমের মানবিক সদস্যরা।

করোনাভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করতে নিজ উদ্যোগে সারা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মহানগর এলাকায় জলকামানের মাধ্যমে জীবানুনাশক স্প্রে ছিটানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল পুলিশের উদ্যোগে। স্বাভাবিক মৃত্যুও যেন করোনা আতঙ্কে আচ্ছাদিত। মানুষ কোন লাশের ধারে কাছেও ভিড়ছে না। মহানগরের রাস্তায় পড়ে থাকা নিথর প্রাণহীন দেহের একমাত্র সহায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মানবিক সদস্যরা। লাশের ওয়ারিশ বের করা এবং শেষ পর্যন্ত যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় লাশ সৎকারের কাজটিও করেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অকুতোভয় সদস্যরা।

মহানগর এলাকায় দরিদ্র, নিম্ন আয়ের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সংখ্যা কম নয়। দীর্ঘদিন এসব দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ ঘরে থাকায় আয় রোজগারের পথ বন্ধ। এসময় সিএমপি উদ্যোগ নেয় পুলিশ সদস্যদের নিজেদের বেতনের টাকা দিয়ে তাদের মুখে আহার তুলে দিতে। নগরবাসীদের যেন কেউ না খেয়ে থাকে, সেজন্য নিজেদের বেতনের অর্থ দিয়ে শুরু করলেন রাতের অন্ধকারে প্রকৃত দরিদ্র খুঁজে খুঁজে তালিকা তৈরি করে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের এমন মানবিক উদ্যোগে মহানগরের কিছু হৃদয়বান,  বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছেন। তারা তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, পুলিশ নিজেই কতটা নিরাপদ? চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মানবিক সদস্যরা করোনা মোবাবিলায় ফ্রন্ট লাইনে কাজ করায় ছিল সংক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকি। এ কথাটি সত্য। তবে পুলিশের প্রতিটি স্থাপনা, অফিস, থানা-ফাঁড়ির প্রবেশমুখেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুলিশ সদস্য কিংবা সেবা প্রত্যাশী যে কোন ব্যক্তি থানায় কিংবা পুলিশ অফিসে প্রবেশ করলেই হাত ধোয়ার পাশাপাশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার দ্বারা দু’হাত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের থাকার ব্যারাক নিয়মিত ব্লিচিং পাউডার কিংবা জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার করা হয়েছে। দৈনন্দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ শত কাজের বাইরে করোনাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ যে ভূমিকা রেখেছে, তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যুগে যুগে।

লেখক : অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ, চট্টগ্রাম।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট