চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

‘অন্তহীন’ নমুনা সংগ্রহ শেষে থামছেন তাঁরা

তাসনীম হাসান 

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১২:৫৬ অপরাহ্ণ

কথা দিয়েছিলেন যতদিন দেশে করোনার টিকা আসবে না, ততদিন মানুষের নমুনা সংগ্রহ করে যাবেন। প্রায় সাত মাস ধরে সেই কথা রেখে গেছেন তাঁরা। এখন এসে গেছে করোনা বধের অস্ত্র টিকা। দেশজুড়ে যেন চলছে ‘টিকা উৎসব।’ তাই আগামীকাল রবিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) শেষ হচ্ছে তাদের নমুনা সংগ্রহের কাজ। তার আগে অবশ্য সংগ্রহ করেছেন ১ হাজার ৬০০ এর বেশি মানুষের নমুনা। এই ‘তাঁরা’ হচ্ছেন তরুণদের একটি দল। ‘অন্তহীন ফাউন্ডেশন’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ছাতার নিচে থেকে যারা দেশজুড়ে নানা সামাজিক কাজ করে যাচ্ছেন।

২০২০ সালের জুন মাস। করোনা মহামারীর চূড়ান্ত সময় তখন। চারদিকে শুধু এই কয়েকটা শব্দ ভয়, উদ্বেগ আর আতঙ্ক। দরজা এঁটে তাই প্রায় মানুষ হয়ে পড়েছেন ঘরবন্দী। মরণের ভয় এমন চূড়ায় পৌঁছে স্বজনের মরদেহ নিতে হাসপাতালেও আসেনি অনেকে। সেই সময়ে প্রাণের ভয়, স্বজনদের মায়া, ঘরের টান-সব তুচ্ছ করে এই ফাউন্ডেশনের সদস্যরা ছুটে গিয়েছেন মানুষের কাছে। পরম যত্নে সংগ্রহ করেছেন নমুনা। পরদিন আবার ফোন করে করে সেই নমুনার ফল পৌঁছে দিয়েছেন ঘরে ঘরে। 

ফিরোজ শাহ আরবান ডিসপেনসারি সেন্টার থেকে শুরু হয়েছিল এই ফাউন্ডেশনের নমুনা সংগ্রহের কার্যক্রম। দিনটি ছিল ২০২০ সালের ১০ আগস্ট। এরপর সপ্তাহের ছয়দিন তাঁরা ছুটেছেন কখনো পাঁচলাইশ আরবান ডিসপেনসারিতে, কোনদিন হালিশহর আরবান ডিসপেনসারি। আবার কোনোদিন ছুটেছেন আগ্রাবাদ, শেরশাহ কিংবা নিউমার্কেটের স্কুল হেলথ আরবান ডিসপেনসারিতে। মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে মানুষ পেয়েছেন এই সেবা। অন্তহীন ফাউন্ডেশনটি মূলত বন্ধুদের দলের একটি যৌথ প্রচেষ্টার ফসল।

ফাউন্ডেশনটির দৃশ্যমান কাজ ২০২০ সালে দেখা গেলেও  অবশ্য এর শুরু আরও আট বছর আগে ২০১২ সালে। এই ফাউন্ডেশনের বর্তমান সদস্য ১৮টি দেশের ১৫০ জন তরুণ। তবে শুরুটা হয়েছিল ৫৬ বন্ধুর হাত ধরে। এই তরুণেরা ছিলেন ২০১২ সালের সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষার পর সবাই নানা জায়গা-দেশে ছড়িয়ে পড়লেও ছিন্ন হয়নি তাঁদের বন্ধুত্ব। করোনা মহামারী শুরু হলে তাঁরা মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না অনুভব করেন। এর মধ্যে এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হন নানা দেশের তরুণেরাও। তাঁরা নানাভাবে সহায়তা করতে থাকে ফাউন্ডেশনটিকে। বাকিটা শোনা যাক ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুল হকের মুখ থেকে।

গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় পূর্বকোণ কার্যালয়ে সাইদুল হক খুলে দেন অন্তহীন ফাউন্ডেশন নিয়ে নানা স্মৃতির জানালা। তিনি বলেন, করোনার সময় আমরা দেখছিলাম কেন্দ্র সংকটের কারণে নমুনা জমা দিতে গিয়ে মানুষকে দীর্ঘক্ষণ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল। এতে যারা আক্রান্ত নন তাঁদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছিল। তাই সহজে নমুনা জমা নেওয়ার জন্য আমরা ২০২০ সালের জুনের ৪ তারিখ সিদ্ধান্ত নিই একটি বিশেষায়িত গাড়ি বানাবো।

এরপর ৯ জুন টাঙ্গাইলে সেই গাড়িটি বানাতে দিই। এর মধ্যেই সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ নানা জায়গায় অনুমোদনের জন্য আবেদন করি। ১৭ জুন ব্যাটারি চালিত গাড়িটি চট্টগ্রামে এসে পৌঁছে।’ মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরুর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাইদুল হক বলেন, ‘অনুমতি পাওয়ার পর ১০ আগস্ট থেকে শুরু করি আমাদের কাজ। সপ্তাহের ছয়দিন ছয়টি আরবান ডিসপেনসারিতে গিয়ে মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতে থাকি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) আমাদের কাছে কিটগুলো সরবরাহ করতো। নমুনা সংগ্রহ শেষে ফের তা আমরা তাদের কাছে জমা দিতাম। পাঁচজনের একটি টিম সার্বক্ষণিক গাড়ির সঙ্গে থেকে কাজ করে গেছেন।’

মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে যেন উচ্ছ্বাস ঝরছিল সাইদুলের কণ্ঠে। বলেন, ‘পরিবার সবসময় আমাদের উৎসাহ দিয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে সহায়তা করে গেছেন। আর দিনশেষে মানুষের অন্তহীন ভালোবাসাই ছিল সবচেয়ে বড় পাওয়া।’

তবে নমুনা সংগ্রহের কাজ শেষ করলেও আরও নানা সামাজিক কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি। ফাউন্ডেশনের সদস্যরা স্বপ্ন দেখেন একদিন তাদের ফাউন্ডেশনটি দেশের অন্যতম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় রূপান্তর হবে। সারাবছর মানুষের জন্য কাজ করে যাবে অন্তহীনভাবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট