গড় বিল কিংবা মিনিমাম বিলের গ্যাড়াকলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। মোট ৭৩ হাজার মিটারের মধ্যে ৩০ হাজার মিটার অকেজো হওয়ার অজুহাতে এভাবে বিল দেয়া হয় গ্রাহকদের। এতে হাজার হাজার কোটি টাকার নতুন নতুন পানি সরবরাহ প্রকল্প সমৃদ্ধ সংস্থাটি লোকসানে থাকলেও তার বিনিময়ে পকেটভারির অভিযোগ আছে কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। ওয়াসার বিল নিয়ে অনেক পূর্ব থেকে এমন নয়ছয় চললেও এ যাবতকালে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি কারও বিরুদ্ধেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওয়াসার বিল নিয়ে এই কারসাজির পেছনেও আছে বেশ কিছু মিটার ইন্সপেক্টর ও বদি আলমদের (মিটার ইন্সপেক্টর নিযুক্ত এলাকা ভিত্তিক বহিরাগত) হাত। বিলিং ব্যবস্থার এই কারসাজির কারণে স্বাভাবিক নিয়মে পানি সরবরাহ করেও পানির আসল দাম পায় না ওয়াসা। গ্রাহককে অবৈধ সুবিধা দিয়ে অবৈধভাবে পকেট ভারী করে তারা। ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, মিটার পেতে পূর্বের ন্যায় কোনো বিড়ম্বনা নেই এখন। আবেদন করে কাউকে আর মিটারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ব্যাংকে টাকা জমার স্লিপ রাজস্ব বিভাগে গেলেই দিনে দিনে মিটার পান গ্রাহকরা।
অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় মিটার ইন্সপেক্টর ও তাদের নিয়ন্ত্রিত বদি আলমের নিরুৎসাহের কারণে অনেক গ্রাহক নতুন মিটার লাগাতে আগ্রহী নন। তারা বেশি পানি ব্যবহার করে কম বিল দিয়ে ঠকান ওয়াসাকে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গড় কিংবা মিনিমাম বিল উভয়েই হচ্ছে রাজস্ব ফাঁকির ফাঁদ। ওয়াসার পানি চুরি করার আরেক রাস্তা হচ্ছে বাইপাস কিংবা চোরালাইন। ওয়াসার অবৈধ লাইন চিহ্নিত করার কোন কৌশল কারও কাছে না থাকলেও সবই জানেন বিলিং কর্মচারি এবং মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশল কর্মীরা।
ওয়াসার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বছর তিনেক আগে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নির্দেশে বাইপাস এবং চোরা লাইন চিহ্নিত করতে একটি সার্ভিলেন্স টিম গঠন করা হয়। তখন অনুসন্ধানকালে এমনও তথ্য বেরিয়ে আসে যে সংযোগ থেকে মাসের পর মাস এভারেজ হিসেবে মাত্র ৫ হাজার টাকা বিল দেয়া হতো সে সংযোগে মিটার লাগানোর পর ৪০/৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত স্বাভাবিক বিল এসেছে। তখন কিছুদিন অভিযান অব্যাহত থাকলেও পরবর্তীতে রহস্যজনক কারণে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি।
অভিযোগে জানা গেছে, মিটার ইন্সপেক্টরদের নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে বদলি করা হলে পানি নিয়ে নয়ছয় অনেকটা কমে যাবে। তারা গত তিন বছর ধরে একই এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন। সর্বশেষ তাদের লটারির মাধ্যমে বদলি করেন তৎকালীন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিত ভট্টাচার্য খোকন। এ কর্মকর্তার কঠোরতায় তখন ওয়াসার রাজস্ব আয়ও অনেক বেড়ে যায়।
এদিকে অটোমেশন প্রকল্প অনুমোদনের পর গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সংস্থাটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মিটার ইন্সপেক্টরদের নিয়ে বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মীদের দেয়া তথ্যে উঠে এসেছে ৩০ হাজার অকেজো মিটারে গড় এবং মিনিমাম বিল দেয়া হয়। মিটার এবং বিলের এই নয়ছয়ের তথ্যে ক্ষুব্ধ হন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ভাঙ্গা, নষ্ট কিংবা অকেজো মিটারের স্থলে নতুন মিটার সংযোজন করে রিডিং অনুযায়ী বিল করার নির্দেশ দেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, পানির বিলিং নিয়ে গ্রাহক হয়রানির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়ে রাজস্ব শাখা এবং বিলিংয়ে নিয়োজিত মিটার ইন্সপেক্টরদের আরও আন্তরিক হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন। কোনো গ্রাহককে ইচ্ছেমতো বিলের খড়গে আটকে দেয়া যাবে না। গ্রাহক সন্তুষ্টির কথা বিবেচনা করে ওয়াসা আগামীতে ডিজিটাল বিলের আওতায় আসবে। তিনি বলেন, ওয়াসার আয়ের উৎস হচ্ছে রাজস্ব খাত। এ খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতার সাথে কাজ করলে রাজস্ব আয় আরও বাড়ানো সম্ভব।
ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসায় পর্যাপ্ত মিটার মজুদ রয়েছে। তুরস্কের ভাইলান কোম্পানি থেকে আসছে আরও ১৭ হাজার ২০০ মিটার। এসব মিটারে এএমআর (অটোমেটিক মিটার রিডিং) প্রযুক্তি সংযুক্ত আছে। তাছাড়া শেখ হাসিনা-২ প্রকল্পের আওতায় ইটালির বি মিটার মজুদ রয়েছে ৪০ হাজার। নতুন স্থাপিত সাড়ে ৬০০ কিলোমিটার পাইপ লাইনে এসব মিটার বসানো হবে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক ও বাণিজ্যিক মিলিয়ে সর্বমোট গ্রাহক ৭৩ হাজার। বর্তমানে সরবরাহ করা পানির পরিমাণ দৈনিক ৩৬ কোটি লিটার।
পূর্বকোণ/এএ