চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

হাসপাতাল বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা

শফিক রায়হান

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ১:৪১ পূর্বাহ্ণ

হাসপাতাল বর্জ্য জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাতœক হুমকিস্বরূপ। চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল সমূহের বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই বল্লেই চলে। নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতাল বর্জ্যসমূহ অটোক্লেভ মেশিন দ্বারা সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত করে ধ্বংস করে ফেলতে হয়। কিন্তু হাসপাতালসমূহের আশে-পাশে ময়লার স্তূপসমূহে যত্রতত্র রোগীদের ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জাম সমূহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। এই সকল বর্জ্যসমূহ হতে পরিবেশে জীবাণুদের বিস্তার ঘটছে প্রতিনিয়ত। সবচেয়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে কোমলমতি শিশুরা। এই সকল শিশুদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তাদের শরীরে অনায়াসে বাসা বাঁধছে রোগ-জীবাণু। এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মনিটরিং লক্ষ্য করা যায় না কখনো।
বড় শহরগুলোর জন্য মেডিকেল বর্জ্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। ভবিষ্যতের চিন্তা করে প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এখনই সময়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন কাজে জনগণকে সচেতন করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম শহরের অলিতে গলিতে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা প্রায় সকল প্রাইভেট হাসপাতাল/ক্লিনিক সমূহ মাসিক চুক্তিতে বর্জ্য ধ্বংস করার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে ‘চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা’ নামের একটি মাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। এই প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম শহরের প্রাইভেট হাসপাতাল/ক্লিনিক সমূহ হতে দিনে একবার বর্জ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। শুধু বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক নয়, খোদ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে এই সংস্থাকে।
খবর নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ১৩১৩টি (এক হাজার তিনশত তের) । কিন্ত হাসপাতালটিতে প্রতিদিন ধারণ ক্ষমতার ৪-৫ গুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকে। এই বিশাল সংখ্যক রোগীদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়। শুধু রোগীর ব্যবহৃত মেডিকেল সামগ্রীই নয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকসমূহের অপারেশন থিয়েটারে বেরিয়ে আসা রোগীদের দেহের বিভিন্ন অংশগুলো কোথায় ধ্বংস করা হয় সেটিও একটি চিন্তার বিষয়। হাসপাতাল বা ক্লিনিক ছাড়াও শহরে রয়েছে অসংখ্য প্যাথলজি ল্যাব এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
তথ্যমতে, চট্টগ্রাম নগরীতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদিত প্রায় শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রয়েছে আরও দুই শতাধিকরে মতো ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদিসহ রক্ত কিংবা মলমূত্র কোথায় ধ্বংস করা হয় তা অনেকেরই অজানা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিদিন ওয়ার্ডে সাধারণ বর্জ্যের জন্য কালো ডাস্টবিন, ধারালো বর্জ্যরে জন্য লাল ডাস্টবিন, সংক্রামক রোগের বর্জ্যরে জন্য হলুদ ডাস্টবিন এবং তরল বর্জ্যরে জন্য গামলা বা বালতি রয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিষয়ে ধারণা না থাকায় তারা ব্যবহৃত বর্জ্যসমূহ যেই ডাস্টবিনে খুশি সেই ডাস্টবিনে ফেলছে। এত বড় হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় কিংবা আয়াদের নেই প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা। তারাও সাধারণ মানুষের মতই হাসপাতাল বর্জ্যসমূহ যেখানে খুশি সেখানে ফেলছে।
খবর নিয়ে জানা যায়, স্বাস্থ্য বিভাগে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন যাবৎ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সমস্থ ওয়ার্ডবয় এবং আয়াদের অউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা রোগী বা রোগীর স্বজনদের সাথে সর্বক্ষণ অসদাচরণে লিপ্ত থাকে। হাসপাতালটির প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপেই রোগী কিংবা স্বজনদের এই সকল ওয়ার্ডবয় কিংবা আয়াদের পেছনে অর্থ গুনতে হয়। অর্থ নিয়েও যদি তারা সঠিক কাজটি করতো তাহলেও হাসপাতালটির অভ্যন্তরীণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক ভাবে হতো। তারা বর্জ্যসমূহ নিয়মিত হাসপাতালের আশেপাশের ডাস্টবিনে ফেলে আসছে। সেখানে থেকে টোকাইরা বর্জ্যসমূহ সংগ্রহ করে কেজি দরে ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে। এভাবেই জীবাণুরা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বময়। যে হাসপাতালে প্রতিনিয়ত হাসপাতাল বর্জ্যরে ভাগাড় জমছে সেই হাসপতাল হতে ‘চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা’ নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন একবার বর্জ্য সংগ্রহ করছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরেই প্রতিদিন আনুমানিক ৩-৪ টন হাসপাতাল বর্জ্য সৃষ্টি হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি সকল সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক হতে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে প্রতিদিন মাত্র একবার বর্জ্য সংগ্রহ করে অটোক্লেভ অথবা ইটিপির মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত না করে আবর্জনার ভাগাড়ে নিয়ে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দেয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে সরকার ‘চিকিৎসা-বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরন) বিধিমালা, ২০০৮’ প্রণয়ন করেছে। আইন থাকলেও বিষয়টি মানা হচ্ছে না কোথাও। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র যদি এমনই হয়, তাহলে মফস্বল কিংবা গ্রামে অবস্থিত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্যাথলজি সেন্টার কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার বিষয়টির কি অবস্থা তা ধারণার অবকাশ রাখে না। মূলত স্থান ভেদে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের। কিন্তু হাসপাতাল বর্জ্য জীবাণুমুক্ত করার জন্য তাদের কাছে নেই কোন অটোক্লেভ মেশিন। সরকারিভাবে হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অটোক্লেভ কিংবা ইটিপি’র ব্যবস্থা থাকলে হাসপাতাল বর্জ্যসমূহ যথাযথ ভাবে জীবাণুমুক্ত করে জনস্বাস্থ্য এবং জীবাণুমুক্ত পরিবেশ রক্ষা করা অনেকাংশে সহজতর হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাছাড়া, হাসপাতাল বর্জ্য-ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই সঠিকভাবে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা হবে বলেও অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।

লেখক ঁ মেডিকেল প্রতিনিধি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট