চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

অনুমোদন নেই ৫২টি প্রতিষ্ঠানের

বোতল-জারে অবাধে বিক্রি অশোধিত পানি

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৩:৪২ পূর্বাহ্ণ

মিনারেল ও ড্রিংকিং ওয়াটার নামে চট্টগ্রামে বোতল ও জারে ভরে অবাধে বিক্রি হচ্ছে ওয়াসা ও নলকূপের পানি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল পানির এ রমরমা ব্যবসা করে আসছে। বিএসটিআই’র অনুমোদনহীন চট্টগ্রামে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫২টি। অপরদিকে বৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৬টি।
মিনারেল ও ড্রিংকিং ওয়াটার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই বিএসটিআই’র লাইসেন্স নেই। কোথাও লাইসেন্স থাকলেও শর্ত অনুযায়ী পানি পরীক্ষা করা হয় না। পানি বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বিএসটিআই’র কিছু নির্ধারিত মাত্রা রয়েছে। যাকে বলা হয় বিডিএস (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস)। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান মনগড়াভাবে উপাদানগুলোর মাত্রা বা পরিমাণ বোতলের গায়ে উল্লেখ করেছে। জারের গায়ে খনিজ উপাদানের উপস্থিতি বা গুণগত মান সম্পর্কিত কোনো লেবেলই থাকে না। ফলে পানির গুণাগুণ সম্পর্কে কোনো তথ্যই পান না ভোক্তারা।
নগরীতে অর্ধশতেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি মিনারেল ও ড্রিংকিং ওয়াটার সরবরাহের নামে পানির অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে। নিজেদের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তি নামেই তারা এসব ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট থেকে বড় গাড়ি ভাড়া করে পুরো শহরে পানি সরবরাহ করছে। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে হাজার হাজার লিটার কথিত মিনারেল ও ড্রিংকিং ওয়াটার। বিএসটিআই অনুমোদিত নামিদামি কোম্পানির বাজারজাত করা পানির বোতলেও বিভিন্ন সময় ময়লা ও দূষণযুক্ত পানি পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘বিএসটিআই এর অনুমোদন ছাড়া পানির বোতল ও জারের মাধ্যমে বাজারজাত করা আইনত দ-নীয়। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসব অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে। মূলত বিএসটিআই পণ্যের জাতীয় মান-প্রণয়ন, মান-বাস্তবায়ন, গুণগত মানের নিশ্চিয়তা বিধান এবং ওজন ও পরিমাপে কারচুপিরোধসহ সর্বক্ষেত্রে মেট্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। হেলথ্ সেফটি, এনভারনমেন্টাল সেফটি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা নিয়ে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে এসআরও জারির মাধ্যমে এ যাবত ড্রিংকিং ওয়াটার /ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার পণ্যসহ সর্বমোট ১৮১টি পণ্যকে বাধ্যতামূলক মান-সনদের আওতাভুক্ত করা হয়েছে এবং গুণগত মানসম্পন্ন ওইসব পণ্যের মোড়কে বিএসটিআই’র মানচিহ্ন ব্যবহারও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিএসটিআই’র সিএম লাইসেন্সবিহীন ড্রিংকিং ওয়াটার/ন্যাচারেল মিনারেল ওয়াটার পণ্য-উৎপাদন ও বাজারজাত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত আছেন। এ সকল অপতৎপরতা রোধকল্পে বিএসটিআই প্রতিদিনই সার্ভিল্যান্স টিম পরিচালনার মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে মামলা দায়েরসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু এরপরও চট্টগ্রামের ৫২টি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই’র সিএম লাইসেন্স গ্রহণ/নবায়ন না করে অবৈধভাবে বিক্রি-বিতরণ করছে যা দ-নীয় অপরাধ। এর ফলে একদিকে যেমন ক্রেতা-ভোক্তাসাধারণ মানসম্পন্ন পণ্য ক্রয় হতে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বৈধ প্রতিষ্ঠানসমূহ অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে।
ইঞ্জিনিয়ার সেলিম রেজা বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগে বিএসটিআই অনুমোদিত ড্রিংকিং ওয়াটার/ন্যাচারেল মিনারেল ওয়াটার পণ্যের বৈধ লাইসেন্স-প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৬টি। এসব প্রতিষ্ঠানের বাজারকৃত পণ্যের ব্র্যান্ড হচ্ছে সিনমিন, আনন্দ, কে-ওয়াটার, ম্যাক, আর্ক, নিউ ওরিয়েন্ট, রাহীব, ইয়েস, মীর, জারা, মামিয়া, সতেজ প্রিমিয়ার, অ্যাকোয়া হর্স প্রিমিয়ার, দাদা, ফ্রেন্ডস’কো, জিশান, অলওয়েজ, সৈকত, কনফিডেন্স, দিশা, তাসনিম, আল মক্কা, গ্রামীণ ভিওলিয়া, হলি অ্যাকোয়া, কিনলে, তাজ, মারিয়া, ভাইটাল ফ্রেশ, চেঙ্গী ভ্যালী, মীম সুপার, শীতল, স্টার লাইন সেইফ, ভাইটাল ফ্রেশ, সুবর্ণ, স্পেশাল ও নীড।’
বিভিন্ন শ্রেণি পেশা মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুপেয় পানির দুষ্প্রাপ্যতার সুযোগে চট্টগ্রামে প্লাস্টিক কনটেইনার ভর্তি ‘জার’ ও বোতল ভর্তি ড্রিংকিং ওয়াটার/ন্যাচারেল মিনারেল ওয়াটারের রমরমা ব্যবসা চলছে। এ ব্যবসা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কমদামে বেশি পানির প্রলোভন দেখিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। প্লাস্টিকের কনটেইনারে ভর্তি করে ‘মিনারেল ওয়াটার’ নামে বিক্রি করা হচ্ছে এই পানি। অবৈধ পানি ব্যবসার মধ্যে জারের হয় সবচেয়ে বেশি। একটি জারে প্রায় ৪০ লিটার পানি থাকে। দাম মাত্র ৪০ থেকে ৭০ টাকা। এই পানির ব্যবসায় ঘিরে নগরীতে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ উঠেছে, বেশির ভাগ জারের পানি আদৌ পরিশোধন করা হয় না। সরাসরি ওয়াসার সাপ্লাই করা পানিতে শুধু ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে তা জারে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জারের পানি ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশেষ করে নগরীর প্রায় প্রতিটি চা দোকানে জারের ফিল্টার করা প্রতি গ্লাস পানি বিক্রি হয় এক টাকায়। জারের পানি কতটুকু নিরাপদ জানতে চাইলে দোকানদাররা বলেন, আমরা প্রতিটি জার ৫০ টাকা করে ক্রয় করি। বিভিন্ন কোম্পানি পানি নিরাপদ বলে আমাদের দোকানে দিয়ে যায়। আমরাও সরল বিশ্বাসে এসব কিনে নেই। কাস্টমার সরল বিশ্বাসে খায়। আদৌ বিশুদ্ধ কি না আমি তো বলতে পারব না। নগরীর কয়েকটি এলাকায় এভাবেই অনেকের কাছে জারের পানির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। এতে দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষই জারের পানি নিয়ে সংশয়ে আছেন। তবে দোকান বা রেস্টুরেন্টে দেদার বিক্রি হচ্ছে জারের পানি। পথচারী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ নিম্ন-আয়ের মানুষই বেশি জারের পানি পান করছেন। সন্দেহ থাকলেও কারোই স্পষ্টভাবে জানা নেই, ফিল্টার করা পানি মনে করে যা পান করছেন তা নিরাপদ কি না। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই জারের পানির বেশির ভাগই সরাসরি ওয়াসার লাইন কিংবা নিজস্ব গভীর নলকূপ থেকে নেয়া হয়। অথচ বাসায়ও এ পানি ফুটিয়ে ছাড়া কেউ পান করেন না। দিনের পর দিন অস্বাস্থ্যকর পানি সরবরাহের কারবার করে যাচ্ছেন কিছু অসৎ ব্যবসায়ী। মাঝে মধ্যে দু’একটি অভিযান চালানো হলেও পানির মান যাচাইয়ে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, যারা বোতলজাত পানি নিয়ে এভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, জীবন বিপন্ন করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসটিআইকে যথাযথ ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান তিনি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একাধিক কাউন্সিলর জানান, নলকূপের উপর নির্ভরশীল অনেক এলাকার পানিতে আয়রনের মাত্রা বেশি হওয়ার কারণে সামর্থবানরা বাসাবাড়িতে ব্যবহার করছে বোতলজাত পানি। এ সুযোগে নগরীতে নামিদামি কোম্পানির বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের বিক্রি ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে পালা দিয়ে রাতারাতি বেড়ে গেছে অনুমোদনহীন কথিত মিনারেল ওয়াটার সরবরাহকারী স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সংখ্যা। হোটেলসহ নিম্ন ও মধ্যমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসব সরবরাহকারীর কাছ থেকে কমমূল্যে পানি কিনে প্রতি গ্লাস এক টাকা মূল্যে বিক্রি করছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ওয়াসার পানি সরাসরি পানের যোগ্য। কিন্তু সরবরাহের ক্ষেত্রে তা দূষিত হতে পারে। এছাড়া বাসা-বাড়িতে যে ট্যাঙ্কি রয়েছে তা দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করার কারণে পানি দুর্গন্ধ হতে পারে। তিনি বলেন, আগামীতে পানি বিশুদ্ধ করতে ফুটাতে হবে না। সরাসরি মানুষ ট্যাপ থেকে শতভাগ বিশুদ্ধ পানি পাবে। এ লক্ষ্যে ওয়াসা কাজ করে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট