চট্টগ্রাম রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

কর্পোরেটে ভাগ্যবন্দী লাখো খামারির

আরাফাত বিন হাসান

২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১২:০১ অপরাহ্ণ

চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে চুক্তিভিত্তিক খামার বন্ধ, করপোরেট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ ১০ দফা দাবিতে ডিম ও মুরগি উৎপাদন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল খামারিরা। দাবি আদায় না হলে নতুন বছরের শুরু থেকে সারাদেশে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। এরপর প্রায় ২ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি সমাধানে এগিয়ে আসেনি কেউ। অগত্যা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় খামারিরা। এখন থেকেই মুরগি ও ডিম উৎপাদন কমিয়ে আনতে শুরু করেছেন কেউ কেউ। এরমধ্যে লাফিয়ে বাড়ছে মুরগির দাম।

 

এদিকে, পোল্ট্রি খাতের অস্থিরতার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারে। গেল দুই সপ্তাহে খুচরায় সবচেয়ে সহজলভ্য ‘ব্রয়লার’ মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। ৩০-৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সোনালি ও লেয়ার মুরগির দামও।

 

খামারিদের দাবি, গেল কয়েক বছরে মুরগির খাবার, ওষুধ ও বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি মুরগি লালন-পালন শুরু করেছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সরাসরি মুরগি লালন-পালন ছাড়াও পছন্দের খামারির সঙ্গে ‘চুক্তিভিত্তিক’ খামার শুরু করেছে। এতে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছেন না স্বল্প পুঁজির প্রন্তিক খামারিরা। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে লোকসানে পড়ে খামার গুটিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ খামারি। আবার এখনও যারা টিকে আছেন তারাও নিঃস্ব হওয়ার পথে। তাই প্রান্তিক খামারিদের অস্তিত্ব রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের প্রতি কিছু দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। তাদের দাবিতে কর্ণপাত না করায় জানুয়ারি থেকে মুরগি ও ডিম উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

 

এই বিষয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিটন প্রসাদ চৌধুরী বলেন, প্রান্তিক খামারিদের পুঁজি কম। অল্প পুঁজি নিয়ে ছোট ছোট খামার করেন সবাই। তাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাজার কোটি টাকার কার্যক্রমের সঙ্গে আমরা পেরে উঠছি না। আমি নিজেই সম্প্রতি টানা চারবার লোকসানে পড়েছি। আমরা কয়েকবছর ধরে এটা নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু কেউ কর্ণপাত করছে না।

 

তিনি বলেন, শুরুতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু মুরগির খাবার, ওষুধ আর বাচ্চা উৎপাদন করলেও পরে মুরগি লালন-পালন শুরু করে। এতে তারাই বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আমরা লাখ লাখ প্রান্তিক খামারি তাদের সামনে কিছুই না, এই ‘জনা বিশেক’ মোড়লের হাতে আমাদের সবার ভাগ্য বন্দী। চুক্তিভিত্তিক খামার বন্ধ এবং বাচ্চা আর খাবারের দাম কমানো না গেলে প্রান্তিক খামারিদের বাঁচানো সম্ভব না।

 

পোাল্ট্রি শিল্পে প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে গেল প্রায় এক যুগ ধরে যুক্ত ফটিকছড়ির হেঁয়াকো এলাকার ডিলার মো. ইদ্রীস। তিনি বলেন, গেল কয়েক বছরে উত্তর ফটিকছড়িতে যারা খামার করতো তাদের অধিকাংশই লোকসান দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে গেছে। শুরুর দিকে অনেক শিক্ষিত তরুণ এই খাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল, কিন্তু এখন অবস্থা খুবই খারাপ। ভাগ্য ফেরানোর আশায় এই খাতে এসে এখন নিঃস্ব হয়ে ফিরছে সবাই। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী করপোরেট খামারিরা।

 

বিপিএ জানায়, খামারিদের ১০ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে করপোরেট কোম্পানিগুলোকে শুধু ফিড ও মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে সীমাবদ্ধ রাখা; বাণিজ্যিকভাবে ডিম ও মুরগি উৎপাদন বন্ধ করা, ফিড ও মুরগির বাচ্চার সিন্ডিকেট বন্ধ করা; প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা; ক্ষুদ্র খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ ও ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করা; ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা; প্রান্তিক খামারিদের জন্য পৃথক বাজার সুবিধা তৈরি করা; করপোরেট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ; কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বন্ধ করা এবং প্রান্তিক খামারিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া।

 

দেশে মুরগির বাচ্চা ও ডিম উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের সংগঠন ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি)। প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে সংগঠনটির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি।

 

তবে প্রাণিসম্পদ দপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. আতিয়ার রহমান বলেন, খামারিরা খামার বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে। ইচ্ছে করলেই তো আর সবকিছু হয়ে যায় না। এখন ১ জানুয়ারি আসুক, দেখা যাক কী হয়।

 

করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তিভিত্তিক খামার ও প্রান্তিক খামারিদের অন্যান্য দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের সুযোগ আমরা দিয়েছি নাকি? রাষ্ট্র দিয়েছে। রাষ্ট্র যদি চিন্তা করে তাহলে বন্ধ করবে। দুই পক্ষেরই স্বার্থ ঠিক রাখতে হবে। দু’পক্ষকেই টিকে থাকতে হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট