চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক আহমদ

চট্টগ্রাম বন্দর হানাদারমুক্ত করতে পরিচালিত হয় ‘অপারেশন ঈগল’

আবুল কালাম আজাদ হ কাপ্তাই

১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:২০ পূর্বাহ্ণ

মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বীরত্বগাথার নাম অপারেশন ঈগল। মূলত চট্টগ্রাম বন্দরকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা এ অপারেশন পরিচালনা করেন। এ অপারেশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক আহমদ।
লোহাগাড়া উপজেলায় ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি ও চট্টগ্রামের সরকারি এম ই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও মুসলিম হাইস্কুল থেকে বৃত্তিসহ মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৬২ সালে বুয়েট থেকে ১ম ব্যাচে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি কর্ণফুলী পেপার ও রেয়ন মিলস কমপ্লেক্স এ চাকুরিতে যোগ দেন। মুক্তি সংগ্রামের প্রাক্কালে ৭০’র ডিসেম্বরে তিনি দায়ুদ শিল্প গোষ্ঠীর কর্ণফুলী কমপ্লেক্স এর পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কয়েকজন প্রথিতযশা প্রকৌশলীর সাথে ব্যবসায় যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হাতড়ে মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক আহমদ বলেন, ভারতীয় সামরিক নেতৃত্বে তিব্বতীয় বিশেষ সীমান্ত বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর অভিযান ‘অপারেশন ঈগল’ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ১১ অক্টোবর ভারতের দেমাগিরি থেকে। এই ছদ্ম সামরিক গোপন অভিযান একটি অঘোষিত যুদ্ধ। সামগ্রিক নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল এস এস উবান। এটি পরিচালিত হয়েছিল মুজিব বাহিনীর ছত্রছায়ায়। লক্ষ্য একটি ত্রিমুখী আক্রমণে চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে ফেলা ও পাকিস্তান বাহিনীর জন্য অকার্যকর করে দেয়া।

তিনি বলেন, ৭১’র সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে আমি, গোলাম রব্বান, যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, রণবিক্রম ত্রিপুরা, মনীশ দেওয়ান ও সাতকানিয়ার এম এন এ আবু সালেহ মিজোরামের দেমাগিরিতে উপস্থিত হই। সেখানে ডজনখানেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা এবং শ্রদ্ধেয় দালাইলামার নির্দেশে হাজার তিনেক তিব্বতীয় এসএসএফ সদস্যের সমাগম হয়। আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল দেমাগিরিতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে অভিযানের জন্য একটি সহযোগী দল গঠন করা ও পাকিস্তানি সেনা ছাউনিসমূহের জনবল, অস্ত্রশক্তি, মজুদ রসদ ও তার সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা এবং এর জন্য পাহাড়ি গোয়েন্দা নিয়োগ করা।
সিদ্দিক আহমেদ বলেন, ১১ অক্টোবর সূর্যাস্তের পরে অপারেশন ঈগল শুরু হয়। ৩টি কলামে বিভক্ত মিত্রবাহিনীর উত্তরটির লক্ষ্য খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি-রাঙামাটি রোড ধরে চট্টগ্রাম। মধ্যম কলামের লক্ষ্য ঠেকামুখ হয়ে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি-কাপ্তাই রোড ধরে চট্টগ্রাম। দক্ষিণ কলামের লক্ষ্য বরকল-বান্দরবান হয়ে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রোড ধরে চট্টগ্রাম ঘেরাও করা।

আমি দক্ষিণ কলামের মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে থেকে সর্বক্ষণই প্রায় ভারতীয় সেনাপতি কর্নেল নারায়ন, এসএসএফ লিডার থাপ্পা ও ঠাছির সঙ্গে ২য় প্লাটুনের মধ্যভাগে অবস্থান নিই। আমাদের বিশ্রামস্থল ছিল একই জায়গায়। ১৫ অক্টোবর প্রাক সূর্যোদয়ের আলো আঁধারিতে শত্রু শিবিরে আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে ১৬ অক্টোবরের মধ্য রাতে একটি সাপোর্ট গ্রুপকে বেইসে রেখে ১৩০-১৪০ জনের একটি এসল্ট গ্রুপ বেস থেকে একজন করে চেক আউট করে। ফরমেশন ছিল ১০ জনের এক এক সেকশন, ৩ সেকশনের এক এক প্লাটুন, মধ্যম প্লাটুনের মধ্যভাগে কর্নেল নারায়ন ও আমাদের সাথে ২টি মর্টার ও ২টি হালকা মেশিনগান এবং অগ্রভাগে ছিল এসল্ট কমান্ডার মেজর নেইগি। আনুমানিক হাজার খানেক মিটার নিকটে এসে আমরা পাকিস্তান বাহিনীর প্রথম চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেল, এলএমজি ও মর্টারের গোলাবর্ষণের সম্মুখীন হলাম। আমাদের অবস্থান অন্ধকার ও জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ার জন্য পাকিস্তানিরা এরকম লক্ষ্যহীনভাবে এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করছিল এবং স্ফুলিঙ্গ লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে আমরাও ফায়ার দিচ্ছিলাম। সকাল হওয়ার সাথে সাথে কর্নেল নারায়ন মেজর নেইগিকে ইঙ্গিত করলেন আক্রমণ শুরু করার জন্য। সাহসী তিব্বতীয় অগ্রগামী সেকশন শত্রুদের ফায়ার লাইন ডিঙিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো উচ্চ পাহাড়ে অবস্থিত শত্রু ঘাঁটির দিকে। তাদের ২/৩ জন জখম হয়ে পড়ে গেল বটে, মুহূর্তে প্রথম প্লাটুনের অধিকাংশ সদস্য পরিখা ডিঙিয়ে সুউচ্চ পাহাড়ি ঘাঁটির উপরে উঠে গেল। তখনও শত্রুদের এলএমজি, চাইনিজ রাইফেল ও মর্টারের বর্ষণ অবিরত চলছিল। তবে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড লুপ করে দিয়ে শেষ বাংকারটিকে নিস্তব্ধ করে দিল। দূর থেকে পলায়নমান সৈন্যরা আমাদের এমবুশ পার্টির ক্রমাগত আক্রমণের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। পরে ১ জন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন, ১ জন সুবেদার ও ৪ জন পাকিস্তানিদের সহযোগী মিজো সেনা সদস্যের মৃতদেহ পাওয়া গেল। একজন তিব্বতীয় গ্রুপ লিডার ও আরেকজন সেনা সদস্যের মৃতদেহ সৎকার করা হলো।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট