চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘লেজেগোবরে’ কর্ণফুলী ড্রেজিং

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ | ১:২৩ অপরাহ্ণ

কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বোয়ালখালী থেকে কাপ্তাই অংশে ড্রেজিং করবে পাউবো। অপরদিকে, বাকলিয়া থেকে সদরঘাট পর্যন্ত অংশে ড্রেজিং করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর আগে বন্দরের ক্যাপিটেল ড্রেজিং মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। দুটি প্রতিষ্ঠান আলাদাভাবে নদী ড্রেজিংয়ের তিনটি প্রকল্প নিয়েছে। সমন্বয়হীনতা ছাড়াও অপরিকল্পিত-অনভিজ্ঞতার কারণে এসব প্রকল্পে সুফল মিলছে না বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ইদ্রিস আলী গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘পাহাড় দখলের মতো কর্ণফুলীও ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কর্ণফুলীতে প্রকল্প নিতে কোনো অভিজ্ঞতা লাগে না। কাজ শেষ করতে হয় না। হিসাব দিতে হয় না। প্রকল্প নিলেই টাকা আসে। একই জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রকল্প নিচ্ছে। সমন্বয়হীনতা ছাড়াও অনভিজ্ঞতা, অজ্ঞতা, জোচ্চুরি এবং হরিলুট রয়েছে। জবাবদিহিতা নেই।’
কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং নিয়ে এ পর্যন্ত তিনটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ২০১১ সালে কর্ণফুলীতে ক্যাপিটেল ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২২৯ কোটি টাকা। ঠিকাদারি পেয়েছিল মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন। ২০১৩ সালে ঠিকাদারের গাফিলতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কাজের অর্ধেক শেষ করে পালিয়ে যায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এতে জলে যায় সেই প্রকল্প। ২০১৮ সালে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প নেয় বন্দর। তা বাস্তবায়ন করছে নৌবাহিনী। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে ব্যাহত হচ্ছে প্রকল্পের কাজ। এর বাইরে পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়েছে আরেকটি প্রকল্প।
কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘অভিজ্ঞ লোক দিয়ে প্রকল্পগুলো করা হয় না। মালয়েশিয়ান কোম্পানি স্থানীয় এজেন্টদার বালু জাফরকে দিয়ে কাজ করিয়েছেন। অর্ধেকও কাজ না করে পালিয়ে যায়।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, প্রায় দুই’শ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাঙামাটি পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নূরুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ‘২০১৭ সালে কারিগরি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। কর্ণফুলী ও ঈছামতি নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গতিপথ প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে পাউবো।’
প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলী নদীর চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট থেকে নাজিরচর এলাকা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করা হবে। কর্ণফুলী ছাড়াও প্রকল্পে ঈছামতি নদীর ৬ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হবে।
এদিকে, কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ফেরাতে প্রায় ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ই-ইঞ্জিনিয়ারিং ও চায়না হারবার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে প্রকল্পটির কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে মাটি খনন করতে গিয়েই বিপাকে পড়ে তারা। সেখানে জমে থাকা পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় বিভিন্ন পদার্থের কারণে বারবার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে প্রকল্পের কাজ।
প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার এম আরিফুর রহমান বলেন, ‘নদীর খনন কাজ করতে গিয়ে ড্রেজার বন্ধ থাকায় নদীর তলদেশে খননকৃত অংশে ফের পলি জমে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে’।
বন্দর সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় সদরঘাট থেকে উজানের দিকে বাকলিয়ার হামিদচর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার এলাকা চার মিটার গভীরতায় খনন করে ৪৩ লাখ ঘনমিটার পলি ও মাটি তোলার কথা রয়েছে। কিন্তু পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে কারণে বার বার কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মাঝপথে কাজ বন্ধ করে ৩১ ইঞ্চির প্লেটের সাকশন ড্রেজার আনতে হয়েছে।
প্রফেসর ইদ্রিস আলী বলেন, ‘প্রতিদিন ঘণ্টায় দেড় হাজার ঘনফুট মাটি উত্তোলনের কথা ছিল। সেখানে দুই ফুটও উত্তোলন করতে পারছে না। এতে অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে’।
বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১১ সালে কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং কাজ শুরু করেছিল। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল ২২৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছিল মেসার্স মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ড্রেজিং কাজ শুরু হয়। ২০১২ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। মালয়েশিয়ান কোম্পানি ঠিকাদারি কাজ পেলেও কাজ করেছিল দেশীয় প্রতিষ্ঠান। বিএনপি নেতা আসলাম উদ্দিনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
চুক্তি অনুযায়ী ৩৬ লাখ ঘনমিটার নদীর তলদেশ খনন ও তলানি অপসারণ, এক লাখ ৪৮ হাজার ৫০ ঘনমিটার নদী তীর ও খালমুখের বর্জ্য অপসারণ, ৫০ একর ভূমি পুনরুদ্ধার, ৩ হাজার ৫০০ মিটার শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, ৪০০ মিটার জেটি সুবিধা সম্প্রসারণ, ৩ হাজার ৪৩০ মিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ৩টি কালভার্ট নির্মাণ, ৪ লাখ ৪১ হাজার ৮০০ স্লোব প্রোটেকশন সিসি ব্লক স্থাপন ও ৩৫ হাজার ৪৪৪ মিটার পাইলিং করার কথা ছিল।
কিন্তু প্রকল্পের শুরু থেকে কাজের মান ও অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছিল পরিবেশবাদীদের। প্রকল্পের অনিয়ম ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আর আলোর মুখ দেখেনি প্রকল্পটি।
তবে সেই ড্রেজিং প্রকল্প কর্ণফুলী নদীর জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ড্রেজিং মাটি ভরাট করে বাকলিয়া, চাক্তাই এলাকায় গড়ে ওঠেছে শত শত অবৈধ স্থাপনা। নদীর তীরে জেগে ওঠা চরের জায়গা দখল করে ড্রেজিং কোম্পানির জাফর আলম প্রকাশ বালু জাফর ও জসিম উদ্দিন কোটি কোটি টাকার মালিক বনেছেন। সেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে এখন সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে।
প্রফেসর ইদ্রিস আলী বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, প্রকল্প শেষ করার কোনো তাগিদ নেই। জবাবদিহি না থাকায় প্রকল্প আস্তে আস্তে পতিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। সমন্বয়হীনতার ঘাটতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে দেশপ্রেম ও সততার অভাব’।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট