চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ফিল্ড হাসপাতাল হোক এই যুদ্ধের ক্যান্টনমেন্ট

আহমেদ শরীফ শুভ

৮ জুন, ২০২০ | ৩:০৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামসহ দেশের হটস্পটগুলোতে কোভিড পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের সরকারি ও সীমিত আকারে সেবাপ্রদানকারী বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের স্থানও অবশিষ্ট নেই। সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রোগীরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একটি বেড পাওয়ার আশায়।
স্বাভাবিক অবস্থায় যারা সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবা নিতে আসতেন না, তাদের অনেকেই এসব হাসপাতালে কোন রকমে ভর্তি হতে পারলে বেঁচে-বর্তে যান, এমন অবস্থা। এই দুরবস্থার মধ্যে অনেক সঙ্কটাপন্ন রোগী আবার হাসপাতালমুখী না হয়ে বাসায় চিকিৎসা নেয়ার চেষ্টা করছেন। অথচ এই রোগীদের অধিকাংশেরই প্রয়োজন অক্সিজেন এবং রক্তের ঘনত্ব কমানোর ওষুধ। এই দু’টির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে হাজার হাজার কোভিড আক্রান্ত রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু জীবনরক্ষাকারী এই দু’টি উপাদান সরবরাহের জন্য যে প্রযুক্তিগত আর ভৌত অবকাঠামোর প্রয়োজন তা হচ্ছে হাসপাতাল, যা এখন কানায়-কানায় পূর্ণ।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় যে বিদ্যমান স্থায়ী হাসপাতালগুলোতে স্থান সংকুলান হচ্ছে না এবং যেগুলোতে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে সেগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় বিশেষ ও বাস্তবসম্মত সমাধানের পথে। এই পরিস্থিতিতে অনতিবিলম্বে চট্টগ্রামসহ দেশের হটস্পটগুলোতে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি বিশাল আকারের ফিল্ড হাসপাতালের বদলে চট্টগ্রামের কয়েকটি কমিউনিটি সেন্টার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একশ’ বা দুইশ’ শয্যার একাধিক অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা প্রয়োজন। একটি বিশাল আকারের কেন্দ্রীয় ফিল্ড হাসপাতালের চেয়ে ছোট পরিসরের একাধিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা করা সহজতর। তাছাড়া, ফিল্ড হাসপাতালের ধারণাটিই মাঠ পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ও প্রান্তে এর অবস্থান থাকলে রোগীসাধারণের পক্ষে এসব হাসপাতালগুলোতে সেবা গ্রহণ সহজতর হবে। এই ফিল্ড হাসপাতালগুলো তেমন কোন উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ার দরকার নেই। যেহেতু হাসপাতালগুলো হবে অস্থায়ী এবং মাঠপর্যায়ে, সেহেতু সেগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন বাস্তবানুগ হবে না। তাই সহজেই স্থানান্তরযোগ্য (পোর্টেবল) অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরের মাধ্যমে রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে। এরজন্য ভৌত অবকাঠামোগত কোন পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। এমন একটি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রথাগত হাসপাতাল বেডের পরিবর্তে মেঝেতেও বেডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং তাকেও কোভিড-রোগীরা কৃতজ্ঞতার সাথে লুফে নেবেন। খুব সহজেই ২/৩ দিনের মধ্যেই এই স্থাপনাগুলোকে অস্থায়ী ফিল্ড হাসপাতালে রূপান্তর করা সম্ভব।
এরপর যা প্রয়োজন হবে, তা হচ্ছে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার ও কনসেন্ট্রেটর সংগ্রহ। সেই সাথে কিছু সি-প্যাপ মেশিনের যোগান দিতে পারলে আরো ভালো হয়। এই মেশিনগুলোর ব্যবস্থা হয়ে গেলে ফিল্ড হাসপাতাল পরিচালনায় রক্তের ঘনত্ব কমানোর ওষুধের প্রয়োজন হবে। এছাড়া কিছু সহায়ক ওষুধও লাগবে, যা সহজপ্রাপ্য। এই ওষুধ ও মেশিনপত্রগুলোর কোনটিই আলাদা আলাদাভাবে খুব বেশি দামি নয়। তবে ফিল্ড হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাপক পরিমাণে দরকার হলে শুধু চট্টগ্রাম মহানগরের জন্যই বেশ মোটা অংকের বাজেটের প্রয়োজন হবে। ইতিমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি চট্টগ্রামের বেশ কিছু বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অর্থ সহায়তা দেয়ার সদিচ্ছা পোষণ করেছেন। সাধারণ মানুষ থেকে সমাজে উঁচুতলার অনেক মানুষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের দৃশ্যমান উদ্যোগের অভাবে এই প্রতিশ্রুতি ও সদিচ্ছাগুলো বাস্তব ফল বয়ে আনতে এখনো সক্ষম হয়নি।
একশ’- দুইশ’ শয্যার এলাকাভিত্তিক এই ফিল্ড হাসপাতালগুলো সহজ প্রযুক্তির হবে বলে এগুলো পরিচালনার জন্য খুব বেশি উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও লোকবলের প্রয়োজন হবে না। এমন প্রতিটি হাসপাতাল একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বা রেসপিরেটরি ফিজিশিয়ানের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করা সম্ভব। মুষ্টিমেয় কয়েকজন মধ্য ও প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক পরিচালনায় সাব-এসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, নার্স ও ডিপ্লোমা নার্সদের মাধ্যমে এই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব। প্রয়োজনে মাসিক চুক্তিভিত্তিক কিছু স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবীদের কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য-সহকারী হিসেবে কাজে লাগানো সম্ভব। সামাজিক দূরত্বের বিধি নিষেধের মধ্যেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও কনসেন্ট্রেটর চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া ও রক্তের ঘনত্ব কমানোর ওষুধ বিতরণ ও নিয়ন্ত্রণ করার নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে ফিল্ড হাসপাতালগুলোর অর্থায়ন করা কঠিন কোন বিষয় হবে বলে মনে হয় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই হাসপাতালগুলো স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে কে, পরিচালনাই বা করবে কে? দেশের বিভিন্ন প্রয়োজনে এবং সঙ্কটের সময়ে অতীতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ও পরিকল্পিতভাবে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হয়েছে। একটি দক্ষ ও সংগঠিত কর্মশক্তি হিসেবে সেনাবাহিনীর সামর্থ্য সর্বজনবিদিত। সরকার এই সংকটময় সময়ে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানোর কথা ভেবে দেখতে পারেন। তাদের পক্ষে খুব সহজেই ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন ও পরিচালনা করা সম্ভব। সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তাদের এখনই কাজে লাগানোর সময়। বর্তমান আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের সেনাবাহিনীকে নিয়মিত যুদ্ধে ব্যবহারের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্ত কোভিড-যুদ্ধে আমরা তাদের সহজেই কাজে লাগাতে পারি। তাদের কাজে লাগানোর এখনই সময়।
কোন কারণে যদি সরকারি উদ্যোগে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা সম্ভব না হয় তবে বেসরকারি উদ্যোগেও তা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। কয়েকটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্বপ্রণোদিত হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় এমন ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নিতে পারেন। তারা উদ্যোগ নিলে চট্টগ্রামের চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ চিকিৎসকরা তাদের সহযোগিতায় নিঃসন্দেহে এগিয়ে আসবেন। সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সেক্টর- কর্পোরেশন, এমনকি এনজিওদের পক্ষেও এই উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব।
কেউ কোথাও একটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন ও সাফল্যের সাথে তা পরিচালনা করতে পারলে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় এ ধরণের বেশ কিছু ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে উঠবে। সারা দেশের হটস্পটগুলো সেই মডেল অনুসরণ করতে পারবে।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশ একটি অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধ পরিচালনার ক্যান্টনমেন্ট হতে পারে ফিল্ড হাসপাতাল। কালবিলম্ব না করে তা স্থাপনের সময় এখনই। দেশের প্রয়োজনে যদি সেনাবাহিনীকে কাজে লাগাতে হয় তবে মুক্তিযুদ্ধের পর বর্তমানের চেয়ে উপযোগী সময়- সুযোগ এবং প্রয়োজন আগে কখনো আসেনি। আমরা যেন জীবনে একবার আসা এই সুযোগটি না হারাই, এই প্রয়োজনটি উপেক্ষা না করি। হাজার হাজার কোভিড রোগী ও তাদের পরিবারগুলোর কাছে এটি আমাদের দায় জ্ঞান করতে হবে।
লেখক: অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, অনাবাসিক শিক্ষক – বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ফ্যামিলি মেডিসিন এন্ড রিসার্চ, ইউএসটিসি ও প্রেসিডেন্ট, সোশ্যাল হেল্প এন্ডেভার ফর বাংলাদেশ (সেবা)।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট