চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

হালদায় চলছে ডলফিন হত্যা, দায় কার?

মোহাম্মদ আলী

১৪ মে, ২০২০ | ৮:২৯ অপরাহ্ণ

আড়াই বছরে হালদা নদীতে বিপন্ন প্রজাতির ২৪টি ডলফিনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেও মামলা হয়েছে একটি। তাও এখনো পর্যন্ত শনাক্ত হয়নি কোন আসামি। এ কারণে সংঘবদ্ধ একটি চক্র রুই জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) মা মাছ শিকারের পর এবার ডলফিন হত্যায় নেমেছে। গত ৮ মে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার এলাকার ছায়ার চর নামক স্থানে একটি ডলফিন হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১০ মে মামলা করেছে বন বিভাগ। তবে ঘটনার ৬দিন পরও আসামি শনাক্ত হয়নি। এতে হালদাতে বিপন্ন প্রজাতির ডলফিনের জীবন হুমকিতে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার ফারহানা লাভলী দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘হালদার ডলফিনের দায়িত্ব বন বিভাগের। এ ব্যাপারে মামলাসহ যাবতীয় কর্মকান্ড বন বিভাগই পালন করবে। হালদাতে এর আগে বহু ডলফিন মারা গেছে। এ নিয়ে বন বিভাগ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করলে এ সমস্যা হতো না। তারপরও আমরা যেহেতু হালদার মাছ রক্ষায় কাজ করি, সেহেতু নদীর ডলফিন রক্ষায়ও মৎস্য বিভাগের ভূমিকা থাকবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোয়াজ্জম হোসাইন বলেন, ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১২ সালের ৩৭ ধারায় বলা হয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণি রক্ষার দায়িত্ব বন বিভাগের। সুতরাং স্তন্যপায়ী প্রাণি হিসেবে হালদার ডলফিন রক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব বনবিভাগের পড়েছে। শুনেছি বনবিভাগ রাউজানের উরকিরচরে ডলফিন হত্যার জন্য একটি মামলা দায়ের করেছে।’

এদিকে জানতে চাইলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্য প্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রাম) আবু নাছের মো.ইয়াছিন নেওয়াজ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ডলফিন হত্যার জন্য গত ১০ মে একটি আনডিডেক্টভ মামলা হয়েছে। মামলার আসামি শনাক্ত হয়নি। শনাক্ত করতে জোর তদন্ত চলছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূল্যবান চর্বির লোভে ৮ মে হালদা নদীর একটি ডলফিন কেটে হত্যা করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। গত আড়াই বছরে হালদা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এ ধরণের ২৪টি ডলফিনের মরদেহ। এর আগে ২৩টি ডলফিনের মৃত্যু হয় ইঞ্জিনচালিত বালুবাহি ড্রেজারের আঘাতে। ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হালদা নদী থেকে প্রথম একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছিল। এরপর একের পর এক ডলফিনের মৃত্যু হয়।
করোনার কারণে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ সব ধরনের কলকারখানা। এতে নদীতে দূষণ অনেকটা কমে আসে। এর ফলে হালদা নদীতে বিচরণ বাড়ে ডলফিনের। এই সুযোগে ৫২ কেজি ওজনের ডলফিনকে কেটে ক্ষতবিক্ষত করে এর চর্বি নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ চক্রটি।
চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় এ ডলফিন শুশক নামেও পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে গাঙেয় প্রজাতির ডলফিন রয়েছে প্রায় ১২শ’। প্রকৃতি সংরক্ষণের জোট- ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনভেনশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এই ডলফিনকে ২০১২ সালে বিপন্ন প্রজাতির লাল তালিকায় রেখেছে।
হালদার ডলফিন প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘গ্রামের মধ্যে একটি কূসংস্কার আছে। ডলফিনের চর্বি থেকে তেল তৈরি করে বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। ওই ধারণা থেকে সংঘবদ্ধ একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করেছে। এটা হালদার জন্য অশনি সংকেত।’
প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘হালদা নদীতে ১৭০টি ডলফিন রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী এ চিত্র পাওয়া গেছে। এছাড়াও জরিপে আঘাতজনিত কারণে হালদাতে ডলফিনের মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা হয়। জরিপে ডলফিন মৃত্যু বন্ধে ৬টি সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখনো বেশিভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।’
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ রুহুল আমিন বলেন, ‘হালদাকে সবাই আপন ভাবতে না পারলে ডলফিন রক্ষা করা যাবে না। হালদা নদীতে প্রশাসন পুরো বছর ধরে কাজ করে আসছে। ডলফিন হত্যার পর আমাদের ভিন্নমাত্রা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং ডলফিন রক্ষায় সংঘবদ্ধ ওই চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাবে প্রশাসন।’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৮তম ডলফিনের মৃত্যুর পর এটি পোস্টমটেম করা হয়। রিপোর্টে বালিবাহি ইঞ্জিনচালিত ড্রেজারের আঘাতে ডলফিনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর হালদা নদীর সব বালু মহালের ইজারা বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তে ইতিবাচক ফল আসে। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকে নদীতে ডলফিনের মৃত্যু। কিন্তু সর্বশেষ গত ৮ মে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার এলাকার ছায়ার চর নামক স্থানে একটি ডলফিনের হত্যা ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে গত ১১ মে ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্টে একটি রিট দাখিলের পরদিন হালদা নদীতে ডলফিন রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ই-মেইল যোগে জানাতে বলা হয়েছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট