চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আস্থা বাড়াতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের

নিজস্ব প্রতিবেদক

২৯ মার্চ, ২০২০ | ৭:২২ অপরাহ্ণ

‘যে রোগীই হোক, তাকে সেবা দিতে হচ্ছে। সাধারণ রোগীই হোক কিংবা করোনার রোগী। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কে থাকেন। শুধু তারা না নিজের ভেতরও আতঙ্ক বিরাজ করে, প্রতিদিন কতো রোগী আসে। কার মধ্যে ভাইরাস আছে, সেটি বলাতো যায় না। তবুও এ পেশায় যেহেতু এসেছি, জীবনবাজি রেখে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি।’

এভাবেই কথাগুলো প্রতিবেদককে জানালেন- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফৌজদারহাট সংক্রমক ব্যাধি (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে নিয়োজিত এক চিকিৎসক। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর থেকে রোগীদের সেবা দিতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ছাড়াই দিন পার করতে হচ্ছে তাঁকে। শুধু এ চিকিৎসকই নয়, চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত অধিকাংশ চিকিৎসক এবং নার্স বা স্টাফরাও তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন। যারা বেলা শেষে ঝুঁকি নিয়েই ফিরছেন নিজ ঘরে। যা শুধু পরিবারের মধ্যেই নয়, বরং ঝুঁকিতে ফেলছে গোটা কমিউনিটিকে। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বারবার করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে। তবে একে একে বেরিয়ে আসছে নানা দুর্বলতা।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংস্পর্শের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কোন রোগীই প্রথমে বলতে পারে না যে- তিনি এ ভাইরাসে আক্রান্ত। এ ক্ষেত্রে ওই রোগীকে শরণাপন্ন হতে হয় নার্স ও চিকিৎসকদের কাছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বলেও অভিমত তাদের। নার্স ও চিকিৎসকদের জন্য পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুপমেন্ট (পিপিই) থাকার কথা থাকলেও চট্টগ্রামের চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন। তাই এ বিষয়টি শীঘ্রই সমাধানের দাবি নার্স ও চিকিৎসক নেতাদের। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে রেজিস্ট্রার্ডকৃত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। তারমধ্যে এক তৃতীয়াংশই সরকারি হাসপাতালে নিয়োজিত। বাকিরা কোন না কোন বেসরকারি হাসপাতালে চেম্বার করছেন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে কিছু পিপিই সরবরাহ করা হলেও অধিকাংশ চিকিৎসকেই তা পাচ্ছেন না।

নার্স এসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালসহ পুরো চট্টগ্রামে সরকারিভাবে প্রায় দুই হাজার নার্স কর্মরত রয়েছেন। এর বাইরে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও কর্মরত রয়েছে বহুসংখ্যক। তবে এদের কারও কাছেই সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত পৌঁছেনি কোন সুরক্ষার সরঞ্জাম।

স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও ফৌজদারহাট বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য বেসরকারি ও সরকারিভাবে পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুপমেন্ট (পিপিই) দেয়া হয়েছে সর্বমোট এক হাজার ১৭৮টি। আর চট্টগ্রাম জেলা ছাড়া বিভাগের বাকি ১০ জেলার জন্য সরকারিভাবে পিপিই দেওয়া হয় মাত্র ৯শ’। যদিও শুধুমাত্র বিভাগের জন্য স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে চাহিদা দেওয়া হয় ৭৮ হাজার পিপিই। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত পিপিই না থাকায় সরবরাহ দিতে পারছে না বলেও জানায় সূত্র।

এদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোকে কিছু পিপিই দেওয়া হলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নিয়োজিত চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে এখন পর্যন্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। যার কারণে নগরীর অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ রয়েছে। গতকাল শনিবার নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলো ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। এতে করে সাধারণ রোগীদেরও বিপাকে পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে জরুরি সেবা দেওয়া হলেও সেটিও নাম মাত্র। যদিও চিকিৎসকরা নিরাপত্তা সরঞ্জাম না থাকার দোহাই দিয়ে রোগীদের দূর থেকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বিদায় দিচ্ছেন।

গতকাল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কাশি ও জ¦র নিয়ে নগরীর রামপুর এলাকা থেকে সেবা নিতে আসেন চল্লিশোর্ধ এক ব্যক্তি। কিন্তু জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে দরজার বাইরে রেখেই একটি ব্যবস্থাপত্র দিয়ে চলে যেতে বলেন। পাশে থাকা রোগীর স্বজন অসুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইলেও কোন মন্তব্য করতে চায়নি ওই চিকিৎসক। একই চিত্র দেখা যায়, চমেকের জরুরি বিভাগেও। জ¦র-সর্দি কাশিতে আক্রান্ত কেউ এলেই দূর থেকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে চলে যেতে বলেন কর্তব্যরতরা। অনেককেই না দেখেই পাঠিয়ে দেন ফৌজদারহাট সংক্রমক ব্যাধি হাসপাতালে। এতে করে অনেকটাই হয়রানির শিকারও হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা।

চিকিৎসকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘কিছু কিছু সরকারি হাসপাতালে পিপিই দেওয়া হলেও, বেসরকারি হাসপাতালে নিয়োজিত চিকিৎসকদের দেওয়া হচ্ছে না। আবার সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও ফ্লু কর্নারের নিয়োজিত চিকিৎসকদের পিপিই থাকলেও বহিঃবিভাগে সেবা দেওয়া চিকিৎসকদের নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব সকল চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাদের সুরক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। বর্তমানে তাদের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে’।

চিকিৎসকদের এ নেতাই নন, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়ে অভিযোগ করেন সরকারি হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক ও নার্সও। তারা বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ঢাকায় চিকিৎসকরাও আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু চট্টগ্রামে কোন সরঞ্জামই নেই। তাহলে কীভাবে সেবা দিবে এ অঞ্চলের চিকিৎসকরা। সরকারিভাবে দিবে দিচ্ছে বলে-দিন কাটছে। কিন্তু কখন দিবে, কিংবা আদৌ দিবে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। আগে নার্স ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তা জরুরি। না হলে কোন মতেই ভাইরাস মোকাবেলা সম্ভব হবে না। বরং এটি আরও বেশি ছড়িয়ে পড়বে।

স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদ চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি রতন কুমার নাথ এ প্রসঙ্গে পূর্বকোণকে বলেন, ‘যেখানে নার্সরা রোগীদের সবচেয়ে কাছে থাকেন, সেখানে নার্সদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। একটা পিপিইও দেয়নি সরকারিভাবে। বাধ্য হয়ে নার্সরা নিজেদের অর্থ দিয়ে কিনে ব্যবহার করছেন। অনেকেই ঝুঁকি নিয়েই রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে পড়বে।’

স্বাস্থ্য দপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীরের কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার অবহিত করেছি। আশা করছি শীঘ্রই এ বিষয়ে একটি ব্যবস্থা হবে। ইতোমধ্যে আমাদের হাতে পুরো বিভাগের জন্য সাড়ে ১১শ পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুপমেন্ট (পিপিই) পাঠানো হয়েছে। আজও (শনিবার) সাড়ে তিনশ’ পিপিই আসছে।’

এদিকে, চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকরা বলছেন- ভাইরাস মোকাবিলা করতে হলে সর্বপ্রথম নার্স ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তার বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। শুধু তারাই নয়, সেবায় নিয়োজিত ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাদের আস্থা বাড়াতে হবেব। তা না হলে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে করোনা মোকাবেলায় সাফল্য আসবে না। ফলে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ যেমন চিকিৎসা বঞ্চিত হবেন, তেমনি ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকবে তাদের। তাই যতদ্রুত সম্ভব চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আনতে জনপ্রতিনিধিসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান তাদের।

 

 

 

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট