চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে ফুঁসছে মানুষ

সরকারের ভুল পরিকল্পনার মাসুল বলছে বিশেষজ্ঞরা

নিজস্ব প্রতিবেদক হ ঢাকা অফিস

২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৪:৩০ পূর্বাহ্ণ

সাধারণ মানুষ, ভোক্তা অধিকার কিংবা ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর যুক্তি-অনুরোধ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে যখন মন চাচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। আগামী মার্চ থেকে আবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণায় সারাদেশের মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে। সরকার বলছে- দাম সমন্বয় করতে নাকি এ মূল্যবৃদ্ধি। আর বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন- সরকার লুটপাঠ করতেই মূল্য বৃদ্ধি করছে। এতে করে বিভিন্ন খাতে খরচ বৃদ্ধি পাবে, ফলে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হবে মূল্যবৃদ্ধির চাপ। বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা বলছেন- সরকারের ভুল পরিকল্পনার মাসুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ভর্তুকি সমন্বয় করতে আরো চার-পাঁচ বছর বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, এ খাতের ভর্তুকি সমন্বয় করতে গিয়ে দাম বাড়াতে হয়েছে। এটা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নয়, দাম সমন্বয়। এমন যুক্তির প্রতিক্রিয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ আহমেদ বলছেন, বিশ্ববাজারে তেল, কয়লা, এলএনজি সবকিছুর দাম কম। ব্যয়বহুল ভুল পরিকল্পনার দায় সমন্বয় করতেই জনগণের ওপর বাড়তি দামের বোঝা চাপাচ্ছে সরকার। নতুন বিদ্যুৎ বিলের হারে খুচরা গ্রাহকদের ইউনিট প্রতি ৩৬ পয়সা করে বাড়ানো হয়েছে। একইসঙ্গে বাড়ানো হয়েছে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ও সঞ্চালন চার্জও। এ দাম মার্চ মাস থেকে কার্যকর হবে অর্থাৎ এপ্রিল মাসে গ্রাহকরা এই বাড়তি দামে বিদ্যুৎ বিল দেবেন।

শহরের থেকে গ্রামে অর্থাৎ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের মোট ১ কোটি ৩৮ লাখ লাইফ লাইন গ্রাহকের মধ্যে ১ কোটি ২১ লাখ গ্রাহকের প্রত্যেকের বিল বাড়বে মাসে ৫ থেকে ৬ টাকা করে। আর বাকি ১৭ লাখ লাইফ লাইন গ্রাহকের প্রত্যেকের বিল বাড়বে ১৫ থেকে ১৮ টাকা করে। সুতরাং নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর মূল্যবৃদ্ধির তেমন একটা প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। তেলভিত্তিক কেন্দ্রের কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, তাই বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের, এমন যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। কিন্তু জনগণ তো সমন্বয় বোঝে না, তাকে বাড়তি দাম দিয়েই বিদ্যুৎ কিনতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাড়ানো হয়েছিলো বিদ্যুতের দাম।
জনবিচ্ছিন্ন বর্তমান সরকার গণমানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা না করে আবারো বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি এবং আগামী মার্চ থেকে তা কার্যকরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এক বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অবিলম্বে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় রাজপথে নেমে জনগণ বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে সোচ্চার হবে’।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বর্তমান বিনা ভোটের সরকার জবাবদিহিতার তোয়াক্কা করে না বলেই একের পর এক গণবিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে, যা মার্চ থেকে কার্যকর হবে। ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩৬ পয়সা। দাম বৃদ্ধিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠলেও সরকার তা পরোয়া করে না’।

এদিকে গতকাল দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, গণমানুষ, ভোক্তা অধিকার কিংবা ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর যুক্তি-অনুরোধ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে যখন মন চাচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটছে। জনগণকে শোষণ করে আওয়ামী সিন্ডিকেটের মুনাফার জন্য সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগের আমলে এই নিয়ে ৯ বার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে সাধারণ মানুষের। শিল্প মালিকদেরও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ দশা। দেশীয় শিল্পকারখানা ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধের মাধ্যমে দেশকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি অযৌক্তিক উল্লেখ করে বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। বিবৃতিতে নেতারা বলেন, সরকারের ভুল নীতি-দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণেই আজ বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। বারবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ফলে জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। তারা বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়লে, তার প্রভাব সর্বক্ষেত্রেই হয়। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম, বাড়ি ভাড়া, গাড়ি ভাড়া বেড়ে যাবে। এতে জনগণের জীবন-জীবিকা চরম সংকটে পড়বে’।

বাম নেতারা আরও বলেন, রেন্টাল, কুইক রেন্টালের নামে বেসরকারি ব্যক্তি মালিকদের মুনাফার উদ্দেশ্যে লুণ্ঠনের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের দিতে হচ্ছে। ফলে এই লুটপাটের দায় জনগণ কেন নেবে?
বিবৃতিতে অবিলম্বে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্যও সবার প্রতি আহ্বান জানান নেতারা।
বিবৃতিতে সই করেছেন- বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের সমন্বয়ক বজলুর রশিদ ফিরোজ, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সা. সম্পাদক মো. শাহ আলম, বাসদ সা. সম্পাদক খালেকুজ্জামান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সা. সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদ (মার্কসবাদী) এর সা. সম্পাদক মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সা. সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সা.সম্পাদক মোশরেফা মিশু, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের হামিদুল হক প্রমুখ।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণাকে যুক্তিহীন ও একপেশে অভিহিত করে বর্ধিত দাম প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি, সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন ও সা. সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এ আহ্বান জানান।

নেতারা বলেন, বিভিন্ন গণশুনানিতে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বিদ্যুতের মূল্য কমানোর পক্ষে যেসব যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়, তা খ-ন করতে পারেনি। তারপরও ভোক্তাদের সব যুক্তি অগ্রাহ্য করে তারা গ্রাহক পর্যায়ে ৫.৩ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। তারা বলেন, ‘বিদ্যুতের আরেক দফা মূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ ভোক্তাদের ওপর যেমন আর্থিক চাপ তৈরি হবে, তেমনি উৎপাদিত পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাবে। বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে জনজীবনের সংকট বৃদ্ধি করবে’।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরীক খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেছেন, ‘সরকার জনগণের ওপর বেপরোয়া শোষণ চালাচ্ছে। নতুন করে বিদ্যুতের দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি জনগণের ওপর সরকারের চরম জুলুমের বহিঃপ্রকাশ। নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে জনদুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি পাবে’।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এবং নির্বাহী সমন্বয়কারী (ভারপ্রাপ্ত) আবুল হাসান রুবেল যুক্ত বিবৃতিতে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানান এবং অবিলম্বে এ গণবিরোধী সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানান।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট