চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

জমি রেলের তবে রাজা শাহ আলম

লিজ নিয়ে নানা প্রশ্ন, নীরব মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৪:৩৩ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের পাশেই আইস ফ্যাক্টরি রোডে প্রায় এক লাখ বর্গফুট জমি লিজ নিয়েছেন রেলের ঠিকাদার শাহ আলম। নামমাত্র মূল্যে নিয়ম-নীতি না মেনে এ জমি লিজ দিয়েছে রেলের ভূ-সম্পদ বিভাগ। গত দুই বছরে এ জমিতে এক কোটি ১৯ লাখ ২২ হাজার টাকা রাজস্ববঞ্চিত হয়েছে সরকার। ২০১৮ সালের শেষ দিকে এ জমি লিজ দেয়া হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় বলা হয়েছে- চট্টগ্রামের স্টেশন রোড, মাদারবাড়ি, আগ্রাবাদ, ষোলশহর স্টেশন, পাহাড়তলী, টাইগারপাস, আইস ফ্যাক্টরি রোড, ষোলশহর ১নং ও ২নং গেট এলাকা, ঢাকার কমলাপুর, শাহজাহানপুর, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, গোপীবাগ, স্বামীবাগ, তেজগাঁও, ঢাকা বিমানবন্দর, মালিবাগ, কারওয়ানবাজার, নারায়নগঞ্জ স্টেশন, ৫ নম্বর ঘাট, জিমখানা, নারায়ণগঞ্জ ১ ও ২ নম্বর গেট ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার রেলভূমি (খোলা) প্রতি বর্গফুট বাৎসরিক লাইসেন্স ফি ১০০ টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডে ৯৯ হাজার ৩৬০ বর্গফুট জমি প্রতিবর্গফুট ৪০ টাকা করে বছরে ৩৯ লাখ টাকা ফিতে লিজ দেয়া হয়েছে। এতে প্রতি বর্গফুটে ৬০ টাকা হিসাবে বছরে ৫৯ লাখ ৬১ হাজার ৬ শ’ টাকা রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে সরকার। গত দুই বছরে এক কোটি ১৯ লাখ ২২ হাজার টাকা রাজস্ববঞ্চিত হয়েছে। ২০১৮ সালের শেষের দিকে ঠিকাদার শাহ আলম আইস ফ্যাক্টরি রোডে রেলের ৯৯ হাজার ৩৬০ বর্গফুট জমি লিজ নেন। তাতে তাঁর মন ভরেনি। লিজের বরাদ্দের আশেপাশে আরো এক দশমিক ৬৮ একর জমি দখলে নিয়ে শক্ত স্থাপনায় গড়ে তুলেছেন মার্কেট। প্রতিটি দোকান দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করে বিক্রি করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কোনোটি দোকান ১৫ লাখ টাকায়, কোনোটি ২০ লাখ আবার কোনোটি ২৫ লাখ টাকায় দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে কিনেছেন ব্যবসায়ীরা।
আইস ফ্যাক্টরি রোডের মূল্যবান এ জমি লিজ দেয়ার অনিয়ম খুঁজতে রেল মন্ত্রণালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হলেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন।

শাহ আলমের রেলের জমি লিজ কাহিনী এখানে শেষ নয়। মাছ চাষের কথা বলে হালিশহরে অবস্থিত বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমীতে প্রায় ২৬ একর জলাশয়, কদমতলী নতুন স্টেশনে পুলিশ ব্যারাকের জায়গায় গড়ে তুলেছেন লন্ড্রি, ১২টি সেলুন, সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে দোকান করার কথা বলে ৫০০ বর্গফুট জমি লিজ নিয়ে পাঁচ হাজার বর্গফুট দখল করে তাসফিয়া গার্ডেন নামে একটি একটি খাবারের দোকানও খুলেছেন। এর বাইরেও রয়েছে একাধিক রেলে খাবার ও এটেনডেন্ট সরবরাহের ব্যবসা।
পুর্বাঞ্চল রেলে একরের পর একর মূল্যবান জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ দখলদারের পাশাপাশি নামমাত্র মূল্যে লিজের নামে একের পর এক ভূমি চলে যাচ্ছে দখলদারের হাতে। বছরের পর বছর ধরে এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলেও রেল মন্ত্রণালয় কিংবা রেলওয়ে সংসদীয় কমিটি রহস্যজনকভাবে নিরব ভূমিকা পালন করছে।

অথচ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি এসব বিষয় দেখভাল করার জন্য ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সাংসদ ফজলে করিম চৌধুরীকে সভাপতি করে রেলের দশ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নুর, শফিকুল ইসলাম শিমুল, শফিকুল আজম খান, মো. সাইফুজ্জামান, এইচ এম ইব্রাহিম, নাছিমুল আলম চৌধুরী ও গাজি মুহাম্মদ শাহ নওয়াজ। রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, পূর্বাঞ্চল রেলের মালিকানাধীন জমি রয়েছে এক হাজার ৪ একর। এর ৭৮০ একর জমি রয়েছে দখলদারের হাতে। আর চট্টগ্রামে ২২৩ একর জমি বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে। সাম্প্রতিক উচ্ছেদ অভিযানে ২৫ একরের মতো জমি উদ্ধার করেছে রেলের ভূ-সম্পদ বিভাগ।
বাসা ভাড়া বাণিজ্য : আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসাবাড়ির ব্যবস্থা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। অতীতে দেখা গেছে- বাসা ভাড়া বাণিজ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা- কর্মচারীদের তালিকা তৈরি করা হয় ওই পর্যন্তই। এই উপরি আয়ের কারণে বাসা ছাড়তে হয়েছে কিংবা বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ অন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন নজির নেই বললেই চলে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি বাসা বরাদ্দ নিয়ে অন্য কাউকে ভাড়া দিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর শাস্তি হিসাবে বদলি বা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির সুপারিশও করো হয়েছে। সেই সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।

রেলওয়ের তথ্যমতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের আওতাধীন নগরীর ৩০টি কলোনিতে চার ক্যাটাগরিতে মোট পাঁচ হাজার ৩২৯টি বাসা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্য ১৫৩টি, দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের জন্য ২৩৭টি, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য দুই হাজার ২৫৫টি এবং চতুর্থ শ্রেণীর জন্য দুই হাজার ৬৮৪টি বাসা রয়েছে।

নগরীতে রেলওয়ের অধীনে থাকা কলোনিগুলো হলো- স্টেশন কলোনি, স্টেশন রোড এলাকা কলোনি, পলোগ্রাউন্ড কলোনি, হাসপাতাল কলোনি, সিআরবি অফিসার্স কলোনি, টাইগারপাস কলোনি, ফ্লোরাপাস কলোনি, লালখানবাজার কলোনি, পাহাড়তলী নিউ ঝাউতলা কলোনি, পাহাড়তলী ঝাউতলা কলোনি, পাহাড়তলী টিপিপি কলোনি, পাহাড়তলী ডিজেল কলোনি, পাহাড়তলী উত্তর আমবাগান কলোনি, পাহাড়তলী ওয়্যারলেস কলোনি, পাহাড়তলী দক্ষিণ আমবাগান কলোনি, পাহাড়তলী সেগুনবাগান ও রেঞ্জ রোড কলোনি, পাহাড়তলী এক্স-ই জন কলোনি, পাহাড়তলী ফিল্টার বেড কলোনি, পাহাড়তলী মাস্টার লেন কলোনি, পাহাড়তলী শহীদ লেন কলোনি, পাহাড়তলী নিউ শহীদ লেন কলোনি, পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভেলুয়ার দীঘিরপাড় কলোনি, পাহাড়তলী সিগন্যাল কলোনি, পাহাড়তলী পাওয়ার হাউস ও বাজার কলোনি, পাহাড়তলী স্টেশন কলোনি, পাহাড়তলী লোকো কলোনি, পাহাড়তলী হাসপাতাল কলোনি, ফ্রান্সিস রোড কলোনি এবং ইঞ্জিনিয়ার কলোনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট