চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

নাক-কান-গলার চিকিৎসা মানেই নগরীতে ‘রেফার’!

ইমাম হোসাইন রাজু

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ১২:১৪ অপরাহ্ণ

পুকুরে গোসল করতে গিয়ে কানের ভেতর পানি প্রবেশ করে মধ্যবয়সী যুবক মুন্নার। কানের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে ছুটে যান নিজ উপজেলা সাতকানিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে হতভম্ব এ যুবক। এর কারণ হিসেবে মুন্না বলেন, ‘হাসপাতালে কানের     চিকিৎসা করার মতো যন্ত্রপাতি নেই। নেই চিকিৎসকও। যার কারণে খোদ কর্তব্যরত চিকিৎসকও অন্যত্র যাওয়ার পরামর্শ দেন। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে সাধারণ সমস্যার সমাধান হয় না, এটি রীতিমতো অবাক হওয়ার মতোই।’

 

অবশ্য নাক কান গলা বিভাগের কার্যক্রম না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘একপ্রকার বাধ্য হয়েই রোগীদের রেফার করতে হয়। সবমিলিয়ে ডাক্তার আছে মাত্র ৪ জন। তারমধ্যে ইএনটির চিকিৎসক-যন্ত্রপাতি কিছুই নেই।’ কানের ভেতর কটন থেকে যাওয়া চার বছর বয়সী শিশু রাফিউল আলমকে নিয়ে চমেক হাসপাতালের ইএনটি বিভাগে আসেন তার বাবা ও মা। ফটিকছড়ি থেকে ছুটে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে এ দম্পতি জানান- প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেও ডাক্তার না থাকায় সেখান থেকে হাসপাতালটিতে রেফার করা হয়।

 

এমন চিত্র শুধু এ দুই হাসপাতালের নয়- চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্রও প্রায় একই। যেখানে নাক কান গলার সমস্যা নিয়ে রোগীরা এলেই পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে শহরের হাসপাতালে। যার বেশিরভাগ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আসলেও অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এতে করে রোগী ও স্বজনদের কষ্টের পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থও ব্যয় করতে হয়।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের উপজেলা বা গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র থাকলেও এসব হাসপাতালে নাক-কান গলা রোগ বিভাগের পৃথক কোন ইউনিট কিংবা বিশেষ সেবা কেন্দ্র নেই। যার দরুন চমেক হাসপাতাল কিংবা শহরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভিড় করে থাকেন রোগীরা। এছাড়াও ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও নাক-কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ বা কনসালটেন্ট আছেন মাত্র পাঁচ জন। অর্থাৎ ১৫ উপজেলার মধ্যেই ১০টি উপজেলাতেই নেই নাক-কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। শুধু তাই নয়, কোন উপজেলা হাসপাতালে হয় না অস্ত্রোপচারও।

 

আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। কিন্তু যন্ত্রপাতি না থাকায় অস্ত্রোপচার কিংবা অন্যান্য কোন কিছুই হচ্ছে না। যার কারণে রোগীদের রেফার করতে হচ্ছে।’ তবে সপ্তাহে দু’দিন চিকিৎসা প্রদান করা হয় বলে জানিয়েছেন বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. হীরক পাল। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার থাকলেও যন্ত্রপাতি না থাকায়, জরুরি রোগীদের রেফার করা হয়।’

 

উপজেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক থাকলেও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় বাধ্য হন রেফার করতে। এছাড়াও এনেসথেসিয়া মেশিন ও চিকিৎসক সংকটের কারণে হয় না অস্ত্রোপচার। যার কারণে রোগীদের শহরের বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীর চাপে এমনিতেই বিভাগের একমাত্র টার্শিয়ারি হাসপাতাল চমেক হাসপাতালের অবস্থা নাজুক। এরমধ্যে সাধারণ সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের চাপে জনাকীর্ণ থাকে। অন্যদিকে- গ্রাম বা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে রোগীদের আস্থা যেমন কম, তেমনি সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নাক-কান গলা রোগ বিভাগের সদ্যবিদায়ী বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোস্তফা মাহফুজুল আনোয়ার বলেন, ‘ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সুযোগ সুবিধা আছে। কিন্তু তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ঘরের কাছে যদি সেবা মিলতো, তাহলে রোগীরা দূর-দূরান্ত থেকে বহু পথ পাড়ি দিয়ে শহরে আসতো না। এখন ছোট-খাটো সমস্যার জন্যও তারা ছুটে আসেন শহরে। উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে কাজে লাগাতে পারলে শহরের হাসপাতালেও অনেক চাপ কমে যেতো। সংশ্লিষ্টদের এ দিকে নজর দেওয়া উচিত।’

 

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ও নাক-কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক খান বলেন, ‘স্বাস্থ্য সেবার পরিধি আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু যন্ত্রপাতির অভাবের কারণে সেবা দিতে গিয়ে বিঘœ ঘটছে। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ইএনটি’র সেবা আরও সমৃদ্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত।’

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট