চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিলুপ্তির পথে ঐতিহাসিক দোহাজারী আখেরি স্টেশন

মো. দেলোয়ার হোসেন

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১২:৩৫ অপরাহ্ণ

দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এলাকা দোহাজারীতে অবস্থিত রেলওয়ে আখেরি স্টেশনের ইতিহাস এখনো মানুষ ভুলেনি। যে স্টেশনের নামে একটি সিনেমাও নির্মাণ করা হয়েছিল।

 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দোহাজারীতে ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। দোহাজারী লালুটিয়াতে ময়নার বাপের পাহাড়ে ক্যাম্পের অফিস ছিল। দিয়াকুল আশ্রমের পাশে ছিল রান্নাঘর। ১৬৬৬ সালে মোঘল শাসন আমলে সুবেদার শাসিত রাজধানী ছিল এ দোহাজারীতে। আধু খান ও লসমন সিংহ হাজারী শঙ্খনদীর দু’পাড়ে তাদের ২ হাজার সৈন্য দেয়। দু’হাজার সৈন্য থেকে দোহাজারীর নামকরণ হয়েছিল বলে স্থানীয়ভাবে জানা যায়।  যুদ্ধ পরিসমাপ্তির পর আরাকান জয় হয়। শেরশাহ এ অঞ্চলের রাজা বা শাসক ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন দোহাজারী বারুদখানা এলাকায় গোলাবারুদ রাখা হয়, সেখানে অস্ত্রের ঘাঁটিও ছিল। দোহাজারী দেওয়ানহাটের চরে মাইন (বোমা) পড়ত। হাশিমপুর বাগিচাহাট এলাকায় ছিল তাদের বাগিচা এবং খাদ্য মজুদ রাখার ভাণ্ডার। সে কারণে হাটটির নাম বাগিচাহাট এবং ভাণ্ডারখানা থাকায় ভাণ্ডারী পাড়া নামকরণ হয়েছিল। সেখানে তাদের খনন করা খানদিঘিও রয়েছে।

 

দোহাজারী মোঘল শাসন আমল থেকে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে খান পরিবারের গৃহবধূকে স্বসম্মানে আনার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন। সে ঐতিহ্যবাহী পরিবারের এ স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য চলচ্চিত্রকাররা ষাটের দশকে তৎকালীন খুবই জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী রহমান-শবনমকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘আখেরি স্টেশন’ নামে সিনেমাটি। এ সিনেমাটির দৃশ্যপট নেয়া হয়েছিল দোহাজারী রেল স্টেশন তথা আখেরি স্টেশন থেকে। যা এখনো মানুষ ভুলেনি। এখন সে দোহাজারী রেল স্টেশন তথা আখেরি স্টেশনের সে ব্যস্ততা কিংবা সে চিত্র আর নেই। বর্তমান সরকার দোহাজারী রেললাইনকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শুরু করায় দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।

 

স্থানীয় লোকজন রেলওয়ে স্টেশনের পরে আর কোন লাইন না থাকায় এ স্টেশনকে আখেরি স্টেশন বলে থাকে। সে নামটি মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এক সময়ের ব্যস্ত এ রেল স্টেশন নির্জন হয়ে পড়েছিল।

 

এ ব্যাপারে স্থানীয়রা বলেন, এক সময় ছয় জোড়া ট্রেন চলাচল করত। বর্তমানে মাত্র এক জোড়া ডেমু ট্রেন চলাচল করে। তাও ভোরে স্টেশন ছাড়ে, গভীর রাতে আসে। ফলে আস্তে আস্তে এ আখেরী স্টেশনটি নির্জনতায় পরিণত হয়।

 

তারা আরো বলেন, এ ট্রেনে যাত্রীদের মধ্যে মাদক ব্যবসায়ী, অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িতরাই বর্তমানে বেশি চলাচল করে থাকে। তাছাড়া রাতের আঁধারে ডাকাতি করে অতি ভোরে ডাকাতরা এ ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করে থাকে নিরাপদে। তাদের মতে-সড়ক পথের চেয়ে অকেজো এ রেলপথ ডাকাতের জন্য খুবই নিরাপদ। রেললাইন সংস্কার কার্যক্রম শেষ হলে হয়ত এ দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে আবার দোহাজারী রেল স্টেশন তার পুরোনো যৌবন ফিরে পাবে।

 

ব্রিটিশ শাসন আমলে যারা এ আখেরি স্টেশনটি নির্মাণ করতে দেখেছেন এদের মধ্যে একজন আমানত খান (৯০) বলেন, তাঁর বয়স তখন ৯ থেকে ১০ বছর ছিল। স্টেশনটি ব্রিটিশ সরকার স্থাপন করে। পরে উদ্বোধনের দিনক্ষণও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কোন চালকই কালুরঘাট সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন চালিয়ে দোহাজারী আসতে রাজি হচ্ছিল না। পরে নাজিরহাট এলাকার জনৈক বাদশা মিয়া নামের এক চালক প্রথম ট্রেন চালিয়ে দোহাজারী আসেন। সেদিন এ বিশাল আকৃতির ট্রেনটি দেখার জন্য বহু লোক জড়ো হয়েছিল এ আখেরি স্টেশনে। পরে রেললাইনকে ঘিরে কাঠ, লবণ, সবজি ব্যবসার  প্রসার দিন দিন ঘটতে থাকে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৃহৎ ও অতি ব্যস্ততম স্টেশন হয়ে ওঠে দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন। দিন-রাত মানুষের যাতায়াত, বিভিন্ন পণ্য উঠানামা, কুলি ও শ্রমিকদের ব্যস্ততম জীবন। সব মিলিয়ে আখেরি স্টেশন ছিল দিন-রাত মানুষের মেলা।

 

অবহেলায় দিন দিন এ স্টেশনটি হয়ে পড়ে যেন মানুষশূন্য। এখন গভীর রাতে একটি ট্রেন আসে, স্টেশন ছেড়ে যায় ফজরের আযানের সময়। সারাদিন স্টেশন থাকে নিরব-নিথর। রেললাইনের শেষ প্রান্তে রেলওয়ের জায়গা দখল করে অনেকে বাড়িঘর নির্মাণ করে বিনা বাধায় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব বাসিন্দা মাদক, হেরোইন ব্যবসাসহ চুরি-ডাকাতির সাথেও জড়িত রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। সে সাথে এ সকল ভাসমান বাসিন্দার মলমুত্র উন্মুক্ত অবস্থায় শঙ্খের মধ্যে পাড়ে। এছাড়া গড়ে উঠেছে বার্মাইয়াদের নাম দিয়ে বার্মা কলোনি।

 

সরকার চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইনকে সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রাসারণের কাজ শুরু করেছে। যা আগামী  ২০২৩ সালের জুন মাসে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রাসারণ কাজ শেষে উন্মুক্ত করার আশা ব্যক্ত করেছেন  রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন এমপি। রেললাইন সম্প্রাসারণের ফলে দোহাজারী তথা আখেরি স্টেশনের চিত্র পরিবর্তন হওয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের কর্ম চাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে। সে সাথে দৃষ্টিনন্দন হবে দোহাজারী আখেরি রেল স্টেশন।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট