চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

জানমালের নিরাপত্তায় প্রস্তুত চট্টগ্রাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ মে, ২০২৩ | ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ

ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র আঘাত ও জানমাল রক্ষায় চট্টগ্রামের উপকূলীয় চার উপজেলাসহ জেলার ১৫ উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং প্রায় ৭ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা’র গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আবহাওয়া অধিদপ্তর ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেয়ার পরই ক্ষয়ক্ষতি কমাতে মূল কার্যক্রম শুরু করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, সংকেত ওপরে উঠলে আমরা নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করব। ৪ নম্বর সংকেত দেখাতে বললে বন্দরে স্টান্ডিং কমিটির মিটিং হবে এবং অন্যান্য বিভিন্ন কমিটিকে এলার্ট করা হবে। সংকেত ৫-এ গেলে জেটিতে থাকা জাহাজ বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। তবে আপাতত আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংকেত ওপরে উঠলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রাথমিক চাহিদা মিটানোর জন্য ১৫টি উপজেলায় ত্রাণ হিসেবে চাল ও নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিদ্যমান আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রস্তুত রাখার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তারা জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র মোকাবিলায় প্রস্তুতিমূলক সভা করেছেন। বাঁশখালী উপজেলায় ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনও সাইদুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘উপজেলার উপকূলীয় এলাকা ছনুয়া, খানখানাবাদ, গন্ডামারা, সরল, বাহারছড়া, কাথারিয়া, সাধনপুর, পুকুরিয়া, পুঁইছড়ি, শেখেরখীল ও শীলকুপ এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার এবং মুজিব কিল্লাসহ ১১০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাগরে যে সব জেলেরা রয়েছেন তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ৭১টি ইউনিটে এক হাজার ৪২০ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে। উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় মাইকিংয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক মসজিদে কাল (আজ) জুমার নামাজের বয়ানে ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে বলার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সব ইমামকে বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সন্দ্বীপ উপজেলার ইউএনও সম্রাট খীসা বলেন, ‘উপজেলায় ১১২টি সাইক্লোন শেল্টারসহ মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজসহ মোট ১৬২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া উড়িরচরে তিনটি মুজিব কিল্লা ও মুছাপুর ইউনিয়নে একটি মুজিব কিল্লা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে তিন হাজার ভলান্টিয়ার। সঙ্গে প্রস্তুত রয়েছে যুব রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা। পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা রয়েছে।’

অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় কন্ট্রোল রুম খুলেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এখান থেকে জরুরি হটলাইন নম্বরে (০২৩-৩৩৩-৬৩০-৭৩৯) ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও সেবা পাবেন চট্টগ্রামবাসী। পাশাপাশি জানমালের ক্ষতি কমাতে ৪১টি ওয়ার্ডে ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। চসিক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানলে যেন সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সর্বনিম্ম পর্যায়ে রাখা যায় এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনরুদ্ধার কাজ সর্বোচ্চ গতিতে পরিচালিত হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রস্তুতি সভা ও ঘূর্ণিঝড় মোখার গতিবেগ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জরুরি যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম চেম্বার : নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে মেডিকেল সরঞ্জাম, ঔষধ, শুকনো খাবার মজুদ রাখা এবং খাদ্য গুদামের মালামাল জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, নাগরিকদের সচেতনতার জন্য প্রচার প্রচারণা, জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নাগরিকদের আশ্রয় উপযোগী করার জন্য জেলা প্রশাসন, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি এই আহবান জানান দি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি’র সভাপতি মাহবুবুল আলম। গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় মোখা সুপার সাইক্লোনে পরিণত হতে পারে তাই ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জানমাল নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে জনগণকে প্রস্তুত থাকার অনুরোধ জানান।

পটিয়া : নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, এ উপলক্ষে কৃষকদের করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে কৃষকদের পরামর্শ প্রদানের জন্য কৃষি কর্মকর্তাদের চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। শ্রমিক সংকটের ফলে কৃষকদের সমস্যা সমাধানে পটিয়ার সংসদ সদস্য ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী তার নিজস্ব অর্থায়নে কৃষি অফিসের মাধ্যমে হারভেস্টার মেশিন প্রদান করেছেন। এটি ব্যবহার করেও কৃষকদের ধান কেটে দেওয়া হচ্ছে।
সীতাকুণ্ড সংবাদদাতা জানান, সীতাকুণ্ডে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সব দপ্তর। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত প্রস্তুতি সভায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা এসব কথা জানান। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় একটি প্রস্তুতি বৈঠকের আয়োজন করে উপজেলা প্রশাসন। ইউএনও মো. শাহাদাত হোসেনের সভাপতিত্বে এতে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিরা উপকূলকে আরো সুরক্ষিত করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেন। কুমিরার ইউপি চেয়ারম্যান মোর্শেদ হোসেন চৌধুরী বলেন, কুমিরার কয়েকটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ এখনো ভাঙা আছে। নানান কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড এগুলো সংস্কার না করায় কুমিরার আলেকদিয়াসহ আশপাশের এলাকা ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো দ্রুত সংস্কার জরুরি।

সৈয়দপুরের ইউপি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম নিজামী বলেন, সৈয়দপুর পুরো এলাকাটি একেবারে সাগর পাড়ে। কিন্তু এখানে বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশে ভাঙন আছে। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বারবার বলার পরও এসব সংস্কার হয়নি। সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নুরুল আলম দুলাল জানান, আসন্ন ঘূর্ণিঝড়কে কেন্দ্র করে তারা বিভিন্ন দল গঠন করে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। প্রস্তুত আছে এম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন জানান, সীতাকুণ্ড একটি উপকূলীয় উপজেলা। তাই যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখানে আঘাতের আশংকা বেশি থাকে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এ উপজেলাটি বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখন প্রচারণা বৃদ্ধির কারণে সচেতনাও বেড়েছে। তাই আমরা আগে থেকেই এ নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছি। উপজেলায় মোট ৬২টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে উপকূলীয় মানুষের আশ্রয় নেবার জন্য। ঘূর্ণিঝড়ে আশ্রয় নেয়া মানুষের জন্য তাৎক্ষণিক খাবার দেবার জন্য প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার প্রস্তুত রেখেছি আমরা।

আনোয়ারা সংবাদদাতা জানান, আনোয়ারায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রস্ততি সভা গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি তৌহিদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইশতিয়াক ইমনের সঞ্চালয় এ সময় বক্তব্য রাখেন উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অধ্যাপক এম এ মান্নান চৌধুরী, বৈরাগ ইউপি চেয়ারম্যান নোয়াব আলী, অসিম কুমার দেব, কৃষি কর্মকর্তা রমজান আলী, প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার সমরঞ্জন বড়ুয়া, সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা রাশিদুল হক, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফেরদৌস হোসেন, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আনোয়ারুল কাদের, এনজিও ফোরামের সভাপতি নুরুল আবছার তালুকদার, সিপিপির সহকারী পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

সভায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় উপজেলার রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক টিম (সিপিপি), উপকূলের ৫৮ টি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ভবন প্রস্তত রাখা হয়েছে। উপজেলা সার্বক্ষনিক পরামর্শের জন্য কন্ট্রোলরুম, মেডিকেল ক্যাম্প খোলা হয়েছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসকে প্রস্তত রাখা হয়েছে। লোকজনকে সতর্ক করতে উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করা হয়। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের উপকূলের কাছাকাছি থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপকূল সব চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কর্ণফুলী নদী, বঙ্গোপসাগর ও শঙ্খ নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলের বারশত, রায়পুর, বরুমচড়া, বারখাইন ও জুঁইদন্ডী ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইশতিয়াক ইমন বিভিন্ন ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্র গুলো পরিদর্শন করেন। এসময় রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন শরীফ উপস্থিত ছিলেন।

রাঙামাটি : প্রতিনিধি জানান, রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এ উপলক্ষে জরুরি সভা আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেছেন রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমা বিনতে আমিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. শাহনেওয়াজ রাজু, রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন রুবেল, জেলা শিক্ষা অফিসার মৃদুল কান্তি তালুকদার, জেলার সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরাসহ স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীগণ উক্ত সভায় অংশ নেন। সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, আসন্ন মোখার আঘাত থেকে সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাঙামাটিতে কর্মরত সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের ছুটি বাতিল।

পূর্বকোণ/এ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট