চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

অজ্ঞতা, নাকি মানসিক উন্নাসিকতা আমাদের দায়

অনলাইন ডেস্ক

১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ | ১০:১০ অপরাহ্ণ

বতর্মান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিষয় মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার। প্রযুক্তির ঔৎকর্ষ থাকলেও আমরা আজও মানসিক উন্নাসিকতা উপেক্ষা করতে পারিনি। পারিনি বিধায় লৈঙ্গিক পরিচয়কে সামনে এনে মানবজাতির মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছি।

সমাজব্যবস্থায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে আমরা প্রায় সব উপায়ে অবদমিত করে রেখেছি। রাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে মুখ ফুটে তাদের ভোটাধিকারসহ বিভিন্ন অধিকার নিয়ে কিছুটা বললেও বাস্তবিক অর্থে সমাজে তার প্রতিফলন দেখছি না। এর মূল কারণ, তাদের সম্পর্কে অজ্ঞতা, আমাদের হীনম্মন্যতা। সেই সঙ্গে আজও মানুষের মতো শ্রেষ্ঠ হওয়ার পরিপূর্ণ শর্ত অর্জনে সক্ষম না হওয়া। ভাবা যায়, শুধু আমাদের অজ্ঞতার কারণে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা অবজ্ঞা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন?

 

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ফরেন পলিসি প্রাচীন গ্রিস থেকে আধুনিক পাকিস্তান পর্যন্ত একটি জটিল ও বিতর্কিত শব্দের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্থান হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গকে ব্যাখ্যা করেছে। সামাজিকভাবে নারী ও পুরুষ এই দুই লৈঙ্গিক পরিচয় আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছি। বিষয়টি যতটুকু না জৈবিক তার থেকেও সমাজ নির্মাণের দিক দিয়ে কঠোর। যৌনাঙ্গের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সংস্কৃতির জনপথ নারী ও পুরুষ সদস্যদের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যারা পুরুষ বা নারী নন, এমন ব্যক্তিরা আদিকাল থেকেই চরম নিষ্পেষণ ও বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি আজও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিদ্যমান।

তাদের শরীর ও আত্মার মধ্যে সংযোগ নিয়ে তীব্র বিতর্ক করেছেন প্রজ্ঞাবানরা। বিজ্ঞরা আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিকল্প পরিচয়সহ অনেক জনসংখ্যা রয়েছে। যেমন দক্ষিণ এশিয়ায় হিজড়া, থাইল্যান্ডে কাঠোয়েস ও মেক্সিকোতে মুক্স। তবু এই গোষ্ঠীর পথচলা সহজ নয়। বৈষম্য ও সহিংসতা তাদের নিত্যসঙ্গী। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশ তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বলে আইনিস্বীকৃতি ও সম্মান ঘোষণা দিয়েছে। তবে প্রাপ্তিতে তাদের কানাকড়িও নেই।

 

আমরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলতে, শুধু কিছু মানুষকে নগরীর যানজটের মধ্যে টাকা আদায় করতে দেখি, তাদের বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকতে দেখছি। এই হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের যদি আমরা সম্পদ হিসেবে কাজে লাগাতে পারতাম, তাহলে আমাদের দুটি দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠত। এক. আমরা তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে পারতাম। আর দুই. আমরা যে বিভেদহীন এক বাংলাদেশ চাই, তা সত্যিই গড়ে তোলা সম্ভব হতো।

জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ২০১৮-২০২১ সময়কালে তৃতীয় লিঙ্গ সমতার জন্য কৌশল উপস্থাপন করেছিল, তার বাস্তবায়ন আদতে কতটুকু হয়েছে? সে সময় সংস্থার বিশেষ পরামর্শক অ্যাদোউলায়া মার দিয়া লিঙ্গ সমতা ২০৩০ উন্নয়ন এজেন্ডার একটি অবিচ্ছেদ্য দিক অভিহিত করেন, যা (এসডিজি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য হিসাবে) অন্যান্য সমস্ত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রগতি অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবেও উপস্থিত হয়। লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন ২০৩০ এজেন্ডার অন্যতম দিকনির্দেশক। তবে নারী ও মেয়েদের পরিপূর্ণ অধিকারের জন্য সুযোগ উন্মুক্ত ও সুরক্ষিত না করা হলে ‘কাউকে পিছিয়ে না রাখার কোনো সুযোগই দাঁড়াবে না’ বলে উল্লেখ করেন।

 

রাষ্ট্র তাদেরও। তবে দেখুন, কী নিদারুণ পদ্ধতিতে আমরা তাদের বঞ্চিত করে রেখেছি। অথচ আমরা মহত্ত্বের শিখরে অবস্থান করছি! এই লজ্জা এক দিনের নয়। যদের আমরা গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, কর্মক্ষেত্রে তাদের জায়গা দিতে চাই না। তারা কিন্তু আমাদেরই সন্তান। কেন আমাদের পাশে তাদের সহ্য করতে পারছি না।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভাড ডিভিনিটিন স্কুল বলছে, প্রতিটি প্রধান বিশ্বধর্মের উদ্ভব হয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে। সেই সমাজ যেখানে পুরুষরা সংস্কৃতির বেশির ভাগ ক্ষমতা রাখে এবং অন্য কোনো লিঙ্গের লোকেরা মূলত ক্ষমতা থেকে বাদ পড়ে। এই পিতৃতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে কখনো কখনো ধর্মগুলো খুব ভিন্ন উপায়ে অসঙ্গতিকে সমর্থন করে সাড়া দিয়েছে। কখনো-বা লিঙ্গসমতার পক্ষে এটিকে বাতিল ও প্রত্যাখ্যান করে। হিন্দু সমাজে ২ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে লিঙ্গ প্রকাশের লোকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

 

হিন্দুসমাজে তৃতীয় লিঙ্গের প্রমাণ রামায়ণ ও মহাভারতের মতো ধর্ম গ্রন্থে পাওয়া যায়। পাণ্ডুপুত্র অর্জুন তৃতীয় লিঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস জুড়ে প্রায়ই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সম্মান করা হয়েছে। ১৫ থেকে ১৯ শতকের মোগল সাম্রাজ্যের মুসলিম শাসকরা তৃতীয় লিঙ্গ ভারতীয়দের উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দেশে তৃতীয় লিঙ্গের জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই।

অবশ্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের ২০১৩ সালে এক হিসেব দিয়েছিল যা, ১০ হাজারের কমবেশি। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের প্রতি কোনো বৈষম্য করা যাবে না। এখন নাগরিক কারা, তার কথা আবার সংবিধানের নাগরিকত্বের অনুচ্ছেদে বলা আছে। হিজড়ারা জন্মগতভাবে দেশের নাগরিক। ফলে আমার অধিকার যেমন, তার অধিকারও তেমন। সরকার ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় এই জনগোষ্ঠীকে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন তারা সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন। তথ্যসূত্র: ইত্তেফাক

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট