চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

একুশের চেতনায় আজকের বাংলাদেশ

সাজিদুল হক

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ১১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

এক.

সাতচল্লিশের দেশভাগ এই উপমহাদেশে রক্তের দাগ রেখে যায়নি শুধু, চিরস্থায়ী একটি মানসিক ক্ষত রেখে যায়। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে বাঙালি মুসলিমরা মনে করেছিল, তারা স্বাধীন একটি রাষ্ট্র পেয়েছে। সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক দিক থেকে নিরাপদ একটি জন্মভূমি! এ যেন নতুন এক কালপর্বের সূচনা। কিন্তু কিছুটা সময় না যেতেই সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মুখোমুখি হতে হলো বিভৎস এক অভিজ্ঞতার। পাকিস্তানের বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীকে কথা বলতে হবে সংখ্যালঘু উর্দুদের ভাষায়। ইংরেজদের উপনিবেশ শেষ, শুরু হলো ভিন্ন এক নামে পাকিস্তানি উপনিবেশ। নব্য এই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনগণ দেখলো, রক্তস্রোতে ভেসে যাচ্ছে বরকতদের আগামী। রক্তস্নাত পাকিস্তানে সেই মুহূর্তে তৈরি হলো বিভাজনের রেখা। ছাত্রজনতার বিলম্ব হয়নি নতুন পথে হাঁটার। নতুন এই পথ শুধুই ছিলো না ভাষা সংগ্রামের। এটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামেরও লড়াইয়ের পথ দেখিয়ে দেয়। চূড়ান্ত লক্ষ্যাভিমুখী এই পথটা আসলে স্বাধীনতার সেতুবন্ধন। সংগ্রামী চেতনার ইতিহাসের সেই কালের গর্ভে জন্ম বাংলাদেশের। প্রকৃতঅর্থে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম একুশের রক্তক্ষরণ থেকে। বায়ান্নর অন্তর্গত অভিঘাত একই সাথে সাম্রাজ্যবাদকেও চিহ্নিত করেছে। সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষাকে সামনে রেখে রাজনৈতিক লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যায় সেদিনের তরুণ নেতৃত্ব। তরুণ শেখ মুজিব সেদিন বাঙালির লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। ছাত্ররা ভেঙেছিল ১৪৪ ধারা। জেলবন্দী তরুণ মুজিব যুক্ত রেখেছিলেন নিজেকে অনশন রাখার মধ্য দিয়ে। এভাবেই সঠিক ঠিকানা খুঁজে দেখিয়েছেন শেখ মুজিব। ইতিহাসে বিরল ঘটনা, ভাষার জন্য জীবন দান, এবং ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন একটি রষ্ট্রের উদ্ভব। জাতিরাষ্ট্র নির্মাণকল্পে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বেশকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। উপনিবেশের শোষিত মানুষের আকাক্সক্ষাকে বঙ্গবন্ধু ধারণ করতে পেরেছেন বলেই জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল।

দুই.

ভাষা সংগ্রামের মৌল যে চেতনা গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক একটি বৈষম্য বিমোচক রাষ্ট্র, তার নিদর্শনসমূহ স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের অর্ধশতক পর দূরবীনেও দর্শন দুরূহতম। মহানায়ক মুজিবের রেখে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির মূলোচ্ছেদ ঘটে পঁচাত্তরের পটভূমি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী অসাংবিধানিক শাসনের নীতিসমূহের যে বাস্তবতা, সেটা কী বায়ান্নর রক্তার্জিত চেতনার খেলাপ নয়? আজ মোটাদাগে যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের জাতিগত ভাবে, তা হলো, বাংলা ভাষার ব্যবহারে আমরা কতটা ইচ্ছুক? আমরা সরকারি মহলে বা বেসরকারি অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলাকে কী আদৌ মাতৃভাষারূপে গণ্য করছি কিনা? জনগোষ্ঠীর বিকাশে নিয়ামক ভূমিকা পালনে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে রুপান্তর ঘটে একটি জাতিরাষ্ট্রে, আমাদের ক্ষেত্রে তা কি নিয়ন্ত্রিত?

তিন.

ইতিহাস কী শুধুই রাজা বাদশার জয়-পরাজয়ের বিষয়? হাজার বছর ধরে একটি জনপদে কেবলমাত্র শাসকগোষ্ঠীই থাকে না। শাসিত মানুষের সমাজও এখানে আছে। সেই শাসিতের বিদ্যমান সমাজের অভ্যন্তরে যে সংস্কৃতি অর্থাৎ থাকে তাদের চলমান জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত। তাদের প্রত্যহ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের চালচিত্র, সেই লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল, পিছিয়ে জীবনের মুমূর্ষু মুহূর্তগুলো হয়তো বিজয়ীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় না! কিন্তু জাতিগোষ্ঠীর অলিখিত এই   ইতিহাসই মিথ, হাজার বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে কিংবদন্তি বয়ান হিসেবে থেকে যায়। যেহেতু সংগ্রামের, লড়াইয়ের ইতিহাস লিখিত বইয়ে শাসকশ্রেণির নির্দেশে নিষিদ্ধ থাকে, সাধারণ মানুষ অর্থাৎ প্রান্তিকজন হাজার বছরের তিক্ত অভিজ্ঞানকে ধারণ করে মুখ পরম্পরায় রক্ষা করে। একইভাবে বাঁচিয়ে রাখে ইতিহাসের মুখ্য নির্মাতা ও সংগ্রামের মহানায়কের জীবন দর্শন।

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট