চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

কাপ্তাইয়ে বন্ধুদের সাথে অমল ধবল শরতে

ডেইজী মউদুদ

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:১৩ পূর্বাহ্ণ

আমরা যখন কাপ্তাই লেকের নীলজলে মৃদু মন্দ হাওয়ায় ভাসছিলাম, তখন বন্ধু শফিক গুণগুণ করে গেয়ে যাচ্ছিল, ওরে নীল দরিয়া, আমায় দেরে দে ছাড়িয়া, বন্দী হইয়া মনুয়া পাখি আমার কান্দে রইয়া রইয়া’ আর আমাদের বোটটি তখন হাওয়ার তালে তালে সীমাহীন জলের ওপর দিয়ে খল খল গতিতে ছুটছিল নেভাল ঘাট থেকে বেড়াইন্যার পথে। লেকের স্ফীত নীল জলরাশির জলতরঙ্গ পুরো বোট জুড়ে যেন অপূর্ব এক ভালোলাগার দ্যোতনা ছড়াচ্ছিল। শরতের সুন্দর বিকালে মাথার উপরে বিশাল আকাশের খোলা চাঁদোয়া, কখনো বা পেজা তুলার মতো ধবল মেঘেরা উড়ে উড়ে ছুটছিল যেন অলকা থেকে রামগিরির উদ্দেশ্যে, বিরহী যক্ষের বার্তা নিয়ে যাচ্ছিল তার প্রিয়ার কাছে। সুপ্রিয় পাঠক, এতক্ষণ বর্ণনা করছিলাম শরতকালে কাপ্তাই লেকের চোখ জুড়ানো নয়নাভিরাম দৃশ্যপটের কথা।

আর শরতের এ অমল ধবল প্রকৃতিকে উপভোগ করার উদ্দেশ্যেই আমরা চবি ১৫তম ব্যাচের ভ্রমণপিপাসু কয়েকজন বন্ধু মিলে সেদিন ছুটেছিলাম কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে। কাপ্তাই পৌঁছে আমরা ওয়াপদা রেস্ট হাউসে উঠি। এরপর কাপ্তাই বাঁধ আর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করি। তবে প্রচ- নিদাঘের তীব্র তাপদাহ আমাদেরকে শরতের নীলমেঘমালা কে দুচোখ ভরে দেখার সুযোগ দিচ্ছিল না। অগত্যা কি আর করা! আমরা বান্ধবীরা রেস্ট হাউসের শীতল ঘরে জম্পেশ আড্ডায় মেতে উঠি। এমন সরস আর প্রাণবন্ত আড্ডা যেন কতদিন পর পেলাম, সবাই হারিয়ে গেলাম ছাত্রীজীবনে। এমন হাসাহাসি , এমন কথার মালা যেন কতকাল পরে আবার গাঁথলাম। সুর করে গাইলাম ‘আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি, নাচিবি ঘিরি ঘিরি গাহিবি গান’। দুপুরের খাবারে মহা আয়োজন। শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা, বনমোরগ, কাপ্তাই লেকের তরতাজা মাছ দিয়ে ভুড়িভোজ। এরই ফাঁকে বন্ধু বাবুুল কেক নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দেয় বন্ধু রাশিকে। হৈ হৈ রৈ রৈ করে আমরা কেক কেটে রাশির জন্মদিন পালন করি।
পড়ন্ত বিকালে আমরা শৈলনগরী কাপ্তাই এর নেভাল একাডেমিতে যাই। এটি পিকনিক স্পট। সেখানে আরো ভ্রমণপিপাসুরা ও গ্রুপ গ্রুপ করে আড্ডা আর গল্পে মশগুল। খাদ্যের অন্বেষণে ভিড় করা কুকুরগুলো চারপাশে ঘুর ঘুর করলে ও আমাদের আড্্ডা আর গল্পের তা-বে ওরা ও যেন কিছুটা কাবু হয়ে যায়। এরই ফাঁকে আমাদের বোট এসে ঘাটে ভিড়ে। সবুজ পাহাড়ের নিসর্গ সোপান পেরিয়ে আমরা টলমল জলে ভাসা বোটে উঠি। এক নির্মল আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের মাঝে ভটভট শব্দে ইঞ্জিন বোটটি এগুতে থাকে। বোট চলছে তো চলছেই। জলারাশি আর যেন ফুরায় না। জগতের যাবতীয় আনন্দযজ্ঞ যেন আজ রচনা হয়েছিল আমাদের এই ছোট্ট বোটটিকে ঘিরেই। আকাশজুড়ে আবীর রং ছড়িয়ে আস্তে আস্তে সূর্য হেলে পড়ছিল পশ্চিম গগনে। সন্ধ্যা প্রায় ছুঁই ছুঁই। একটা আলো আধারি ল্যান্ডস্ক্যাপ দিগন্ত জুড়ে। দিবারাত্রির এই সন্ধিক্ষণে প্রতিদিন দেখা এই বিশ^প্রকৃতিকে যেন আবার নতুন করে দেখতে পেলাম। কিন্তু, হঠাৎ কি একটা অজানা শুন্যতায় প্রাণটা যেন খাঁ খাঁ করে উঠলো। কিছুক্ষণের জন্য যাবতীয় ভালো লাগায় যেন একটা করুণ সুর বেজে উঠলো। ভাগ্যিস তখন, বোটের ছলাৎ ছলাৎ জলের ঝাপটা এসে আমায় বার বার ভিজিয়ে দিচ্ছিল । শীতল করে দিয়েছিল । এমনই অবস্থায় আকাশে দেখা দিল হাজারো তারার মেলা । সাতটি তারার তিমির হয়ে মিট মিট করে হাসছিল অসংখ্য নক্ষত্ররাজি, স্বাতী, অরুন্ধতী আর সন্ধ্যাতারা। আর একফালি চাঁদ তার সমস্ত রোশনাইকে ছড়িয়ে আকাশটা কে ভরিয়ে দিল অন্যরকম এক সৌন্দর্যে। মায়াবী এই পরিবেশে বন্ধু হেলেন, করবী, পান্না, পপী, রাশি, রুকু আর তুরানি গান ধরলো ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে, উছলে পড়ে আলো/ ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো ’। গান চলছিল। গানের সুরে সুরে কখন যে আমার নেভালঘাটে ফিরে এলাম টেরই পেলাম না। এমনই এক নির্জন বনে সুরালোকে সন্ধ্যারাগে সমুদ্র তীরেই কপালকু-লা হঠাৎ নবকুমারকে দেখে বলেছিল ‘ পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ ?’ ঘাটে তরী যখন ভিড়ছিলো, তখন নির্জন নিরিবিলিতে সুরের মূর্চ্ছণায় আমাদের স্বাগত জানালো হাজার হাজার ঝি ঝি আর ঝিল্লি পোকারা। আমাদের সারাদিনের ভালো লাগায় তারা যোগ করলো আরেক মাত্রা। তাদের বুনো এই সুরের রাগিনী লেকের জলরাশি পেরিয়ে বনবনানী ছেড়ে লাগছিল দুর পাহাড়ের গায়ে।

এই সুর আর মূর্চ্ছণা কে সাথী করেই আমরা ফিরছিলাম কোলাহলমুখর নগরে একরাশ ভালোলাগা নিয়ে। পেছনে ফেলে আসলাম নির্জন বনবনানী আর ধ্যানী পাহাড়মালাকে। ফিরতিপথে রাংগুনিয়ার চায়ের দোকানে বসে গরম গরম চা পান আর কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খাওয়া ও বাদ পড়লো না। ধন্যবাদ দিতেই হয় ট্রিপ আয়োজক বন্ধুদের। বিশেষ করে বাবুল, নাসিম আর মনসুুরকে। আর বিশেষ ধন্যবাদ দিতে হয় ঢাকার বন্ধু রানা, মুহিত, আকতার, শফিক আর রাশিকে। এতদূর থেকে এসে আমাদের সাথী হবার জন্য

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট