চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

হারানো ঠিকানা

নুর আঙ্গেঁজ

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ | ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

নভেম্বরের শেষ বিকেলের নরম রোদ মুছে আকাশে এখন সন্ধ্যা তারার হাট। ব্যস্ত রাস্তায় যানজট। শপিংমলগুলোয় উজ্জ্বল হয়ে জ¦লছে রাত বাতি। এইসব কিছুকে পিছনে ফেলে মিতালী তার চলার গতিকে আরও দ্রুত করে। যেভাবেই হোক রাত আটটার আগেই বাসায় পৌঁছাতে হবে। ছেলে পক্ষ আসার কথা রাত নয়টার ভিতরেই। মামার পছন্দের পাত্র। না করার সাহসই হয় নি। মনে মনে হিসাব করে মিতালী। এইবার নিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে আসা হবে এগারো বার। ভেতর থেকে ওঠে আসা হাসিটা ভেতরেই মিলিয়ে যায়। মিতালী খুব ভালো করেই জানে নিজেকে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে আসা যায়। কিন্তু বিয়ের কনে সেজে সে কোনদিনই হবার নয়। কারণ পাত্রপক্ষের না টা খুব জোরালো থাকে। মেয়ে শ্যামলা হোক তাতে অসুবিধে নেই। কিন্তু খোড়া বৌ? না- না হতেই পারে না। পরে জানাবো এটাই থাকে শেষ উত্তর। মিতালীর বিধবা মা বুঝতেই চায় না। সেই কবে ছোট বেলায় পলিওতে ডান পা টা একটু সরু। তাই হাঁটার সময় খানিকটা বাঁকা হয়ে হাঁটতে হয় মিতালীকে। খুব রূপসী না হলেও অসুন্দর বলা যাবে না। ঘন পাপড়ির চোখ। আর ঠোঁট জোড়ায় গোলাপী আভা যেন ভিতরের সুন্দরতা ফুটিয়ে তুলে। ছোট খাট একটা বেসরকারি অফিসে কাজ করে মা। মা-মেয়ের বেশ চলে যায়। ছোট বোনটা তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এই মিষ্টি সন্ধ্যাটা না গরম, না ঠা-া। তবুও মনে হয় মিতালীর কপালে যেন ঘাম জমছে। সহকর্মী সোহেল অনেক দিন থেকেই তাকে বিরক্ত করে আসছিল। আজ তার বিদ্রুপটা যেন নিজেকে অনেকটাই অসহায় করে তুললো। নারী জীবনে যেন কেউ একজনের থাকাই চাই। নির্দিষ্ট বয়সের পরও যখন সেই তুমিটাই অধরা থেকে যায়। নিজের মন কি তখন নিজেকে খুব মূল্যহীন ভাবে। যেন আর একজন এসে হাত না ধরলেই নারী জীবনই বৃথা। কেন শিক্ষা নিজের অবলম্বন হতে পারে না। সোহেলের প্রস্তাবটায় যেন কাঁটা ছিলো। হুট করে এসে বললো, ‘আমি মানুষটা কিন্তু আপনাকে অনেক কিছু থেকে উদ্ধার করতে পারি।’ খুব মন দিয়ে ল্যাপটপে কিছু দেখছিলো মিতালী। মৃদু হেসেই চোখ তুলে চায়। ‘তাই নাকি। তা আমি কোন সাগরে পড়লাম। আপনি আমাকে উদ্ধার করবেন।’
‘মেয়েদের বিয়েটা ঠিক সময় না হলে তার কোন কদরই থাকে না। আর আপনার তো শারীরিক ত্রুটি। এরপরও দেখবেন কতো বছর চলে যাবে। কেউ আপনার দায়িত্ব নিতেই চাইবে না।’
‘হ্যাঁ, তাতে আপনার অসুবিধে কোথায়?’
‘শত হলেও আপনি আমার সহকর্মী। সহানুভূতি একটু তো থাকেই। তাই বলছিলাম আর কি। আপনার দায়িত্বটা যদি আমি নিই। যদিও বা আমার ছোট ছোট দুটি মেয়ে আছে। ওদের একজন মায়ের দরকার। ওদের মা … …।’
বাকিটা আর শুনেনি মিতালী। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ‘আপনার সাহসের তারিফ না করে পারছি না। এতো স্পর্ধা কে যোগালো আপনাকে। আমাকে অপমান করার। এখনই এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যান।’ মিতালীর চিৎকার চেচামেচিতে একটা ছোট খাটো কা-ই ঘটে যায় অফিসে। এখনো মনটা যেন সেই জায়গাতেই আছে। ছিঃ শব্দটি মুখে এসেও যেন আবার চুপ হয়ে যায়। আজও তাকে এক পুরুষ দেখতে আসবে। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খায় মিতালী। ব্যথায় টন টন করে ওঠা পা টায় রক্ত ঝরছে। পা চেপে বসে পড়ে সেখানেই। পথ চলা দুই মহিলা তাকে এনে বসায় ডিসপেনসারিতে। প্রাথমিক চিকিৎসায় বেন্ডিসটা করে পেইন কিলারের স্টিপটা তুলে দেয় মিতালীর হাতে। আর তখনই চোখ আটকে যায় সেই বহুদিন আগের দেখা মুখটায়। সময়ের ব্যবধান হলেও তাকে চিনতে ভুল হয় না রাজিবের। এই সেই পা। যেখানে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করার জন্য কতোকিছুই না করেছে সে। ব্যায়াম, ম্যাসাজ, নিজের সবটুকু অনুভুতি দিয়ে সেবা করেও পারেনি সফল হতে। পরিণামে দুর্নামের বোঝা মাথায় নিয়ে সেই অসহায় একজনকে রেখে চলে এসেছিল। মনের সেই আকুতিটা কতোদিন চাপা পড়েছিল বুকে। এতো এতো বছর পর আজ আবার সেই পায়ে হাত রাখলো রাজিব। যেন বহু পুরোনোকে আবার নতুন করে পাওয়া। মিতালীর মুখ এখনো যন্ত্রণায় কাতর। রাজিবই প্রথম কথা বলে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে মিতালী?’
হঠাৎ ভেসে আসা নিজের নামটা শুনে চমকায় মিতালী। চেনা অচেনার ছন্দে সেই হাসিটাই মনে করিয়ে দেয়। এ যে তার শুভাকাক্সক্ষী একজন। রাজিব ভাই।
কোথায় ভেসে যায় ব্যথা, কষ্ট, সহকর্মীর অপমান। তার জন্যে অপেক্ষায় থাকা অতিথির আপ্যায়ন। এখন শুধু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজনই। তার অতীত। তার নির্ভরশীলতা।
‘রাজিব ভাই তুমি এখানে?’
রাজিব যেন শুনতেই পায় না। ‘চোটটা কি করে পেলে? পা টানতে কষ্ট হচ্ছিলো মিতা?’
‘না Ñ না আমি সেই আগের মতোই আছি। অসাবধানতায় একটু লেগেছে। তোমার কথা বলো তো রাজিব ভাই। কোথায় ডুব দিয়েছিলে?’
‘কোথাও না। এই শহরেই ছিলাম। একটা চাকরির খোঁজে। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। একদিন বাস থেকে নামতে গিয়ে খুব ব্যথা পাই পিঠে। অনেক দিন বিছানায়। জীবনের সাথে আর পারছিলাম না যুদ্ধে। তাই মন না চাইলেও জমিটা হাতছাড়া করতে হলো। এই দুই মাসের মতো হবে ফার্মেসিটা সাজিয়েছি। কথার পর কথা হয়। রাজিব মিতালীকে বার্গার খাইয়ে পেইন কিলার দেয়। ঘড়ির কাঁটা তখন অনেকটা এগিয়ে। মিতালী যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই রাজিব এসে হাত ধরে।
‘এবার আমরা আমাদের কথা ভাবতে পারি, মিতু?’
কোথা থেকে যেন মনে জোর খুঁজে পায় মিতালী। যে স্বপ্নের কোন স্বাধীনতা ছিলো না। পরাধীন হয়ে মনের কোণে পরে ছিলো বিবর্ণ হয়ে। আজ সেই রঙহীন স্বপ্নে আলপনা আঁকতে চায় রাজিব। এ যে তার পরম পাওয়া। মিতালী শুধু বলে। ‘এবার আর তোমায় অপেক্ষা করতে হবে না।’ আলো ঝলমল রাস্তায় পা রাখতেই মনে হলো রাতটা যেন বাসর সাজিয়েছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট