চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

মার্কিন চিকিৎসক স্যাম অ্যাটারের করুণ অনুভূতি

হৃদয় ফেলে এসেছি ক্ষতবিক্ষত গাজায়

ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

৩০ এপ্রিল, ২০২৪ | ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

[মার্কিন চিকিৎসক স্যাম অ্যাটার মনে করেন তার হৃদয়ের একটি অংশই যেন তিনি গাজায় ফেলে এসেছেন। কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তিনি তার গাজায় কাটানো সময়টাকে। যুদ্ধ শুরু হবার পর এনজিও এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ব্যবস্থাপনায় তিনি তিনবার গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। এখন আবার সেখানে ফিরে যেতে মন চাইছে তার।]

 

স্যাম অ্যাটার মনে করেন তার ফেলে আসা হৃদয়ের সেই অংশটি গাজাবাসীর ভয়াবহ দুঃখ-কষ্ট অনুভব করতে পেরেছিল, তিনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি। গাজা থেকে ফিরে এলেও ফেলে আসা সেই অংশটি এখনো গাজাবাসীদের ভুলতে পারছে না।
স্যাম গাজা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছেন তিন সপ্তাহ কেটে গেছে।
কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে, গতকালও যেন তিনি সেখানেই ছিলেন। কায়-ক্লিষ্ট সেই মুখগুলোও তার সঙ্গেই রয়েছে। তার মনে ভেসে উঠছে জেনার কথা। ইসরায়েলি বোমার আঘাতে আহত নিদারুণ অপুষ্টিতে তরা ছোট্ট মেয়েটি মৃত্যুর দিকে ছুটে যাচ্ছে। হাসপাতালের বিছানায় বিবর্ণ ফ্যাকাসে মেয়ের সামনে বসে আছেন জেনার মা। স্যামকে সন্তানের শেষ জন্মদিনের একটি ভিডিও দেখান জেনার মা। বোঝা যায়- যুদ্ধের আগের দিনগুলো ভালোই চলছিল তাদের। অদূরে আরো একজন মা বসে আছেন নিস্তব্ধ হয়ে। সেই মায়ের ১০ বছরের ছেলেটি সবেমাত্র পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।
স্যাম বলেন, ‘সন্তানহারা ওই মা অসাড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। মাত্র পাঁচ মিনিট আগে মারা গেছে তার সন্তান। কর্মীরা ছোট্ট ছেলেটির মৃতদেহ কম্বল দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ছেলেটির মা ঢাকতে দিচ্ছিলেন না। তিনি আরো কিছু সময় মৃত ছেলের সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলেন। অবিরাম কেঁদে চলছিলেন। প্রায় ২০ মিনিট এভাবেই ছিলেন। কিছুতেই মৃত ছেলের পাশ থেকে যেতে চাচ্ছিলেন না তিনি।’
৫০ বছর বয়সী অন্য এক ব্যক্তি ইসরায়েলি হামলায় দুই পা হারিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ‘তিনি তার সন্তান, নাতি-নাতনি, তার বাড়ি- সব হারিয়েছেন। অন্ধকার হাসপাতালের এক কোণে একা বসে ছিলেন তিনি। তার ক্ষতস্থানে সংক্রমণ ধরেছে। অবিরাম চিৎকার করছিলেন, মরে যাচ্ছি, দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।’
স্যাম বলছিলেন- এ তো গেলো মাত্র ক’জন… আমি জানি না এরূপ সাহায্যপ্রার্থী আরো কত মানুষ সেখানে আছে। আমি একসময় গণনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই মানুষগুলোর কথা আমি এখনো ভাবি, মানুষগুলো এখনো সেখানে আছে।’
স্যাম যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে জন্মগ্রহণ করেছেন। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। তিনি শহরের একটি হাসপাতালে সার্জন হিসেবে কাজ করেন। গাজায় থাকাকালীন তিনি অনেক ভিডিও ডায়েরি করেছেন। তার অভিজ্ঞতাগুলো চিত্রায়িতও করেছেন।
প্রথমবার তিনি ‘প্যালেস্টিনিয়ান-অ্যামেরিকান ব্রিজ’ এনজিওর হয়ে (মার্চ এবং এপ্রিলে) দুই সপ্তাহ ধরে তিনি গাজার হাসপাতালে কাজ করেছেন। সেখানে ‘মারাত্মক আহত রোগী’ ছাড়া আর সব কিছুরই যেন অভাব ছিল। যেদিন তিনি গাজায় প্রবেশ করেন, সেদিনই তিনি সেখানে তীব্র খাদ্যসংকট প্রত্যক্ষ করেন। স্যাম বলেন, ‘আমরা যে গাড়িতে ছিলাম তার ওপর ক্ষুধার্ত লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল। ড্রাইভার তার গাড়ি না থামিয়ে চলতে থাকে। কারণ গাড়ি থামালেই লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ত। তারা আমাদের ক্ষতি করতে চায় না, তারা শুধু খাবার চায়।’
স্যাম শান্তভাবে তার অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করে বলেন, ‘প্রতিদিন রোগীর প্রচুর চাপ ছিল। তার ওপর চিন্তা করতে হতো কাকে বাঁচানো যেতে পারে, কার আশা ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে থাকা রোগীর রক্ত, ফেলে দেওয়া ব্যান্ডেজ, বেদনা আর শোকার্ত স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠত। এই ধরনের ভয়ংকর স্মৃতি মুছে ফেলা যাবে না কখনো।’
স্যাম আরো বলেন, ‘আমি এখনো সব রোগীর কথা ভাবি, যাদের আমি চিকিৎসা দিতে পেরেছি। এখনো সেখানে থাকা সব ডাক্তারদের কথা ভাবি। চলে আসার সময় একটু অপরাধবোধ এবং লজ্জাও পাচ্ছিলাম। কারণ সেখানে অনেক কিছু করা দরকার- যার সামান্যই আমি করতে পেরেছিলাম। আমি এমন লোকদের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছিলাম, যেখানে এখনো তারা আছেন এবং এখনো তারা ভুগছেন।’
গাজায় দুই বছরের কম বয়সী প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জানা গেছে এবং উত্তর গাজার ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা বিপর্যয়কর ক্ষুধার মুখোমুখি বলে জাতিসংঘ জানিয়েছে। স্যাম অ্যাটারের মনে পড়ে, ৩২ বছর বয়সী এক নারী গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। তার সঙ্গে আরো আছেন তার ছেলে, তার মা এবং বাবা। ওই নারীকে বাঁচানোর জন্য সিপিআর দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তার হৃৎপিÐ সাড়া দেয়নি, তাকে বাঁচানোও যায়নি।
স্যাম বলেন, ‘যুবতী এক মা একটি বেঞ্চে শুয়ে ছিলেন। তার বাঁ হাত মেঝেতে ঝুলছে, মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্ত এটি। রুমজুড়ে একজন নার্স তার কান্নারত মাকে সান্ত¡না দিচ্ছিলেন। সেখানে সাত বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে জেনা আইয়াদও ছিল। শুধু কঙ্কাল এবং হাড় তার শরীরে।’
জেনা যুদ্ধে আঘাত পেয়েছিল এবং মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছিল। যে রোগের নাম সিস্টিক ফাইব্রোসিস। যুদ্ধের কারণে তার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে এবং মানসিক আঘাতেও ভুগছিল। স্যাম বলেন, তার দল যখন দক্ষিণ গাজায় ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল জেনার মা তার কাছে আসেন। তাকে বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আমরা তোমার সঙ্গে যাচ্ছি, কিন্তু..। তুমি কেন যাচ্ছ… আর আমরা এখানেই থাকব?’
স্যামকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল যে দক্ষিণের এই গাড়িবহরটি শুধু জ্বালানি এবং খাবার সরবরাহের জন্য অনুমোদিত হয়েছিল। রোগীদের বহন করার জন্য নয়। কিন্তু যাওয়ার আগে স্যাম ও তার সহকর্মীরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পূরণ করে জেনাকে অন্য হাসপাতালে পাঠাতে বলেন। কিন্তু সময় লাগবে। স্যাম যখন জেনার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন, তখন আরো মায়েরা তা লক্ষ্য করছিলেন। তাদেরও সমস্যাক্রান্ত সন্তান বা অন্য কেউ আছে..। অদ্ভুত একটা অস্বস্তি কাজ করছিল তখন স্যামের।
সে যাক, জেনাকে অবশেষে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং এখন রাফাহর কাছে ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কর্পস হাসপাতালে চিকিৎসা করা হচ্ছে তার।
জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধে নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এর মধ্যে অন্তত ১৩ হাজার শিশু এবং ৯ হাজার নারী। যুদ্ধ এখন সপ্তম মাসে প্রবেশ করেছে। যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মিদের মুক্তির আলোচনা এখনো স্থবির। প্রতিদিন এবং প্রতিরাতে আহত ও অপুষ্টির শিকার মানুষগুলো হাসপাতালের শরনাপন্ন হচ্ছে। অথচ ডাবিøউএইচও’র হিসেবেই গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১০টিতে এখন কাজ চলছে।
ত্রাণকর্মীদের জন্য গাজা এ মুহূর্তে খুবই বিপজ্জনক। এপ্রিলের প্রথম দিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তিনজন ব্রিটিশসহ অন্যান্য দেশের মোট সাতজন সাহায্যকর্মী নিহত হন।
স্যাম ইসরায়েলি চেকপয়েন্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায়ই এক থেকে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম।’
মার্কিন এই চিকিৎসক জানান, উত্তরে আরো সাহায্য প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘উত্তরে আরো খাবার, আরো জ্বালানি এবং আরো পানির প্রয়োজন। ত্রাণ প্রবেশের রাস্তাগুলো খোলা দরকার এবং সেখানে এমন অনেক রোগী রয়েছেন, যাদের উত্তর থেকে দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়া দরকার। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে এখন ‘বিস্ফোরণ’ ঘটছে- অফুরান রোগীর।’
স্যাম অ্যাটার আবারো সেখানে যেতে চান। তিনি বুঝেছেন- ডাক্তার কিংবা নার্সদের কাছে ওই রোগীরা কেবল চিকিৎসা সেবাই আশা করেন না, আতংকের ওই নরক-নগরীতে এই ডাক্তার-নার্সরাই তাদের কাছে সম্মানের, মানবতার প্রতিভূ। বন্ধুত্বের এই বন্ধন তাকে আবারো যেন ডাকছে।

 

[সূত্র : বিবিসি]

 

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট