চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

‘যা করবো নিজের ভালো লাগার জন্য, শখ পূরণ করতে করব’

ফারজানা তাবাসসুম

৩ নভেম্বর, ২০২৩ | ১:২৬ অপরাহ্ণ

ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের একটা পেইজ আছে যেখানে ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের। বিভিন্ন ইয়ারের স্টুডেন্টদের লেখা ছোট ছোট গল্প, অনুভূতি শেয়ার হয়। সবই ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের পোস্ট যদ্দুর জানি- স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর বিষাদে ভরা লেখা থাকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেই জীবন সহজ হয়ে যায় না।

ওই পোস্টগুলোর কিছু কমেন্ট দেখলাম- ‘ঢাবিতে পড়েও এতো হতাশা কেন আপনার?’ ‘আমার স্বপ্ন ছিল ঢাবি। আমাদের স্বপ্নই কি আপনার জন্য দুঃস্বপ্ন?’ ‘ভালো জায়গায় পড়েন। তাও এই অবস্থা? সুখে থাকতে ভূতে কিলায় আপনাদের’।

আমি নিজের মনেই হাসি। মনে হয় গিয়ে ওদের ভুল ধারণা ভেঙে দিই। ঢাকা ইউনিভার্সিটি বা কোন নামিদামি ইউনিভার্সিটিতে পড়লেই লোকের জীবন সর্টেড হয়ে যায় না। কানাডা-আমেরিকায় পড়তে বা থাকতে চলে এলেই সব দুঃখ প্লেনে ওঠার আগে রেখে আসা যায় না। বিয়ে হলেই সব সংসার সুখের হয় না। বাচ্চা নিলেই সব সমস্যা চলে যায় না।

তারপর মনে হয় থাক। ওরা এটুকু ভেবে শান্তি পাক যে, ‘ভালো জায়গায় চান্স পেলে, বিদেশে চলে গেলে, বিয়ে-বাচ্চা হলে’ জীবনে আর কোন দুঃখ থাকবে না। ওখানে পড়েনি বলে, বিদেশে যায়নি বলে, বিয়ে হয়নি বলেই জীবনটা সুন্দর না। কোন একদিন এসব পেলেই সব বদলে যাবে।’

এই আশাটুকু নিয়েই তো বাঁচে মানুষ। এটুকু না থাকলে আর থাকে কি? তার ওপর বলতে গেলে শুণতে হবে, নিজে পেয়েছ তো, তাই এসব বল। আসলেই পেয়েছি বলেই জানি । ঢাকা ইউনিভার্সিটির ‘সেরা’ ডিপার্টমেন্টগুলোর একটা ইকোনমিক্স। ভর্তি পরীক্ষায় একদম শুরুর দিকে ছিলাম বলে এই ডিপার্টমেন্ট পেয়েছি।

কি দেখেছি জানেন? একগাদা ছেলেমেয়ে মেডিকেল, বুয়েট, এমনকি ঢাকা ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে ‘ভালো’ কোন ডিপার্টমেন্টে চান্স পায়নি বলে এখানে পড়তে এসেছে। যেখানে আসা আপনার জন্য স্বপ্ন, সেখানে এসেও তারা ওই জায়গাগুলোর জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওখানে চান্স পাওয়া বন্ধুরা ‘ভাব’ নেয়।

এ তো গেলো ইউনিভার্সিটিগুলোর মাঝে কে বেটার সে যুদ্ধ। এরপরের যুদ্ধ আরও অদ্ভুত। একই ইউনিভার্সিটির একেক ফ্যাকাল্টির মাঝে র‍্যাংকিং। একই ফ্যাকাল্টির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের মাঝে র‍্যাংকিং।
এক ডিপার্টমেন্টের বন্ধু আরেক ডিপার্টমেন্টের বন্ধুর দিকে তাকায় করুণা নিয়ে। ওই ডিপার্টমেন্টে পড়ে নাকি কোন ‘ফিউচার’ নেই। অথচ ফিউচার ভীষণ অনিশ্চিত। দিন শেষে ওই তথাকথিত ‘খারাপ’ ডিপার্টমেন্টে পড়া ছেলেটা সরকারি আমলা বনে গেলে তার দাম বেড়ে যায় কোটিগুণ।

‘ভালো’ ডিপার্টমেন্টের বন্ধু একই চাকরির ভাইভা পর্যন্ত গিয়ে চাকরিটা পায়নি বলে কোন আড্ডায় আসে না আজকাল। নিজের চোখে দেখা সব। এজন্যে কেউ ভালো কোথাও চান্স পেলেই তার জীবন সেট, এ গল্প একদম গাঁজাখুরি লাগে আমার কাছে।

এরপর ধরেন বিদেশে আসার কথা বলি। আমি বাঙালি কমিউনিটির সাথে ক্লোজ না। কিন্তু যতদূর দেখেছি এখানের বাংলাদেশিদের মাঝে প্রতিযোগিতা অন্য ধরণের। আসার কতদিনের মাঝে কে বাড়ি কিনল এটা খুব জরুরি। কে কোন গাড়ি ড্রাইভ করছে সেটা তো আছেই। এদেশে ডিগ্রি নেয়াটা দাম বাড়ায় বেশ খানিকটা। কে আগে এসেছে, কত বছর ধরে এখানে থাকে, তা দিয়ে নিজেদের অনেক ‘বড়’ ভাবা লোকজন আছে।

এখন কেউ যদি এ প্রতিযোগিতা গুলোর মাঝে একবার ঢুকে যায়, সে কেমন করে ভালো থাকবে? কেউ না কেউ সারাক্ষণ তার চেয়ে ভালো করছে। ফেসবুকে এলে দেখছে এ নতুন চাকরি পেয়েছে, ও গাড়ি কিনেছে নতুন, আরেকজনের বিয়ে হয়েছে, অন্যজন একটা মেয়ের বাবা হয়েছে।

আর এ বেচারা কোন রকমে নিজের অপছন্দের একটা জবে আটকে আছে। ছেড়ে দেয়ার উপায় নেই এ ইকনমিতে। বিল দেবে কে? এতো দাম সবকিছুর! এর মাঝে আবার ভর্তি হয়েছে মাস্টার্স প্রোগ্রামে। জীবনে খানিকটা স্ট্যাটাস এনেছে সেটা, কিন্তু জীবন বলে কিছু রাখেনি।

কাউকে যে এত স্ট্রাগলের কথা বলে একটু হালকা হবে সে উপায় নেই। বললে শুনতে হবে, ‘কানাডা গিয়ে বেঁচে গেছো। দেশের যে কি অবস্থা! আমি কিভাবে যেতে পারবো তাই বল। কি? অনেক স্ট্রাগল ওখানেও? এইসব বল কেন? নিজে গেছো তাই চাওনা কেউ যাক, তাইনা? হিংসুটে কোথাকার।’

যেচে পড়ে গালি খেয়ে কি লাভ? তারচে কোন উইকেন্ডে বেড়াতে গেলে সে ছবি দেয়া ভালো। শীত এসে গেছে। সূর্য ওঠার আগে কাজে যাবার জন্য বেরোতে গিয়ে হাত গরম রাখার জন্য দেড় ডলারে কেনা টিম হরটন্সের কফি কাপের ছবি দেয়াই ভালো।

এইসব কম্পিটিশনের চক্করে পড়ে কি একাই না হয়ে যাচ্ছে মানুষগুলো! অথচ ভালো থাকতে ভালো ইউনিভার্সিটি বা উন্নত দেশ যেমন দরকার, তার থেকেও বেশি দরকার নিজের প্রয়োজনটা বুঝতে পারা। আমি কি আসলেই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই নাকি বাবা-মায়ের মান রাখতে ওখানে পড়তে হবে?

সরকারি চাকরি হলে কি আমি আসলেই দেশ, বা নিজের জন্য কিছু করতে পারবো নাকি চাকরিটা না পেলে ঠিক পাত্তা পাচ্ছি না বলে এর পেছনে নষ্ট করছি জীবনের সুন্দরতম সময়গুলো? ঠিক কতোটা হলে আমি ভালো থাকবো?

আমার জন্য টাকা বেশি জরুরি, নাকি মানসিক শান্তি, বাড়ি কি আমি কিনতে চাই নাকি মর্টগেজের দুশ্চিন্তাবিহীন জীবন? এই প্রি-ওউনড টয়োটা করোলাতেই তো দিব্যি পাড়ি দিচ্ছি মাইলের পর মাইল। ওই নতুন মারসিডিজটা কি আমার আসলেই শখ নাকি কেবল তাল মেলাতে কিনছি?

অন্যের কাছে দাম বাড়াতে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিলে কেউ কেমন করে ভালো থাকবে? ভালোর তো কোন লিমিট নেই। এর পেছনে ছুটতে ছুটতেই তো এক জীবন পেরিয়ে যাবে!

তুমি ভালো জায়গায় পড়তে চাও? নিজের ভালো লাগে বলে যাও। প্যাশন আছে বলে যাও। লোকের কাছে বাহবা শুনে দিনশেষে ক্লান্ত, হতাশ জীবন কাটাবার জন্য যেও না। তুমি উন্নত দেশে ভীষণ ফ্যান্সি জীবন কাটাতে চাও? বেশ তো। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য জান লাগিয়ে খাটো।

ওই বাড়িটা, গাড়িটা কেন কিনবে না? নিজের শখ মেটাতে কেনো। কমিউনিটিতে ‘দাম’ বাড়াতে না। বিয়ে করতে, বাচ্চা নিতে চাও? নিজের সংসারের স্বপ্ন পূরণ করতে, বাবা-মা হতে নিজেকে রেডি মনে হচ্ছে বলে করো। লোকে কি বলবে ভেবে না।

নিজের ভালো লাগার জন্য কিছু করলে দিনে আঠারো ঘণ্টা কাজ করলেও গায়ে লাগবে না তখন। বেশির ভাগ হতাশা আসে অন্যের টার্মসে নিজের জীবন কাটাতে যাবার কারণে। এজন্যেই দামি ইউনিভার্সিটি, উন্নত দেশে গিয়েও মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগে। একেবারেই সহ্য না করতে পেরে কেউ কেউ নিজের জীবনটাই শেষ করে দেয়।

আমিও এককালে ছুটেছি। দামি জায়গা থেকেই মাস্টার্স শেষ করেছি। ভেবেছি এবার পিএইচডি না করলে মান থাকছে না। বন্ধুরা সব একেক দেশে ফান্ডিং নিয়ে চলে গেছে। ভেবেছি বেসরকারি চাকরিতে বেতন ভালো হলে কি হবে? বাবার কলিগরা আমার বিসিএস না দেয়া, সরকারি চাকরি না করা নিয়ে প্রশ্ন তোলে প্রায়ই। ভুল হল না তো?

তারপর ভেবেছি দেশ ছাড়বো। অনেক পরিশ্রম করে নানারকম ভাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হয়ে কানাডায় চলে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ আসার পর পরই লোকের ভাষায় ‘অড জব’ না করে ভালো একটা জায়গায় চাকরি পেয়ে যাওয়ায় আর কানাডিয়ান ডিগ্রি নিতে যাইনি। কিন্তু ওটা না নিলে লং টার্মে গ্রোথ আটকে থাকে যদি?

সবাই বাড়ি কিনে ফেলছে। আমিও কিনতে পারলে পছন্দের ফার্নিচার রাখার জায়গা নেই ভাবতে হতো না। দেখবো নাকি দূরে কোথাও একটা বাড়ির দাম কেমন? নতুন ছাড়া গাড়ি কিনলে হয় নাকি?

ভারী ক্লান্তির ব্যাপার এমন করে ছোটা। ছুটবো না বা কমফোর্ট জোনে পড়ে থাকলেই ভালো থাকবো তা বলছি না। কিন্তু অন্যের জন্য আর ছুটবো না আমি। যা করবো নিজের ভালো লাগে বলে, শখ পূরণ করতে করব।
চাইলেই বেশির ভাগ মানুষ এ প্রতিযোগিতার শেকল থেকে বেরোতে পারে না। ‘থ্রি ইডিয়টস’কে নিজের প্রিয় মুভি বলে অথচ দিন শেষে ‘আব্বা নেহি মানেগি’তেই আটকে থাকে। এরা ভালো থাকবে কি করে? অন্য কেউ একটু বাহবা দেবে বা গুনবে না ভেবে সব কিছু করতে যাবার মতো দাসত্ব আর কিসে আছে?

এতো প্রেশারের মাঝে থেকে কেউ বিষণ্ণতায় ভুগলে অবাক হবার কিছু নেই। এটাই বরং স্বাভাবিক। তথাকথিত ‘দামি’ জীবনের দাম তো কম হবার কথা না, তাই না?

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট