পৃথিবীতে পিতা-কন্যার ভালবাসাই উত্তম। এমন নিখাদ ভালোবাসা আর নেই। এর বাইরে ছিলেন না মহানবী মুহাম্মদ (সা)ও। দেড় হাজার বছর আগে তিনি পরিবারের মধ্যে কন্যা ফাতেমা (রা) কেই বেশি মহব্বত করতেন। অথচ সে সময় নারীদের অপয়া, সমাজের জন্য বোঝা বলে অনেকে হত্যা করতো।
মহানবী সেই ধারায় আমূল পরিবর্তন আনেন। তাই বলে তিনি কন্যাকে মাথায় তুলে রাখেননি। দুনিয়ার চাকচিক্যের জীবন থেকে দূরে রেখেছেন। তাঁর মতো কন্যাকেও কষ্টের জীবনে অভ্যস্থ করে তুলেন। ফাতেমা (রা) কে বলে দেন, দুনিয়া তোমাদের জন্য কষ্টের স্থান, সব নেয়ামত পরকালে। তাই নিয়মের বাইরে কন্যার কোন আবদার তিনি রাখেননি।
ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ ছিলেন মুসলিম নর-নারীর কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে সম্মানিত। মক্কায় কুরাইশদের দ্বারা তার পিতার উপর নিযার্তন ও দুর্দশার সময় ফাতিমা সবসময় পিতার পাশে ছিলেন।
মুহাম্মদ (সা) এর নবুয়ত প্রাপ্তির ৫ বছর পূর্বে অর্থাৎ ৩৫ বছর বয়সে ফাতেমা (রা) জন্ম গ্রহণ করেন। মহানবীর প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা) এর গর্ভে জন্ম নেন তিনি। অর্থাৎ তিনি খাদিজা (রা) এর কন্যা। মদিনায় হিজরতের পর তিনি মুহাম্মদ (সা) এর চাচাত ভাই আলি ইবন আবি তালিব এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রাসূলের ইন্তেকালের ৬ মাস পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ২৮ বছর জীবিত ছিলেন।
নবুয়তের জীবন পেয়েছেন ২৩ বছর। তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ নছিয়ত বলতেন মুহাম্মদ (সা)। মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। তবে তাঁর কবর চিহ্নিত করা নেই।
ফাতেমা (রা) পবিত্র এবং স্বর্গীয় ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য। যে সমস্ত বিস্ময়কর বস্তু হযরত ফাতেমার আলোকজ্জ্বল জীবনকে আরো অধিক মর্যাদার করে তোলে তা হচ্ছে তাঁর প্রতি মহানবীর অত্যধিক স্নেহ ও ভালবাসা। এই ভালবাসা ও স্নেহ এতই অধিক ও প্রচণ্ড আকারে ছিল যে এটি রাসূলে আকরামের জীবনের অন্যতম বিষয় বলে গণ্য।
রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ। যে তাকে আনন্দ দেবে সে আমাকে আনন্দিত করবে আর যে তাকে দুঃখ দেবে সে আমাকে দুঃখিত করবে। ফাতেমা আমার কাছে সবার চেয়ে বেশী প্রিয় ও সম্মানিত।’
তিনি আরো বলেছেন : ‘ফাতেমা আমার দেহের অংশ, আমার অন্তরাত্মা। যে তাকে অসন্তুষ্ট করে সে আমাকেই অসন্তুষ্ট করলো। আর যে আমাকে অসন্তুষ্ট করলো সে আল্লাহকেই অসন্তুষ্ট করলো।’
‘জনপদবাসীদের কাছ থেকে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের, রাসূলের নিকট আত্নীয়দের, ইয়াতীমদের, মিসকিনদের এবং
মুসাফিরদের। যাতে ধন সম্পদ তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী কেবল তাদের মধ্যে পুণ্জীভূত না হয়। আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা
তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক; আর ভয় কর আল্লাহকে। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা’। (সূরা হাশর: আয়াত-৭)
হাদীসে আছে, মুহাম্মদ (সা) যখন কোন সফরে যেতেন। পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাত করতেন। যাওয়ার সময় সবশেষ সাক্ষাত করতেন ফাতেমা (রা) এর সাথে। তিনি সফর থেকে আসার পরও সবার আগে সাক্ষাত করতেন ফাতেমা (রা) এর সাথে।
মুহাম্মদ (সা) এক সফর থেকে আসলেন। ফাতেমা (রা) এর দরজায় এসে তিনি ফিরে গেলেন। তখন ফাতেমা (রা) বুঝলেন, মুহাম্মদ (সা) সফরে যাওয়ার পর তিনি দরজায় একটি চাকচিক্য পর্দা লাগিয়েছেন। হাসান ও হোসাইন (রা) এর হাতে রূপার দুটি ব্রেসলেট পরিয়েছেন। এই কারণে পিতা নারাজ হয়েছেন। তাঁর দরজায় এসেও কিছু না বলে চেলে গেলেন পিতা। তখন খুব কষ্ট পেলেন তিনি।
ফাতেমা (রা) সাথে সাথে হাসান ও হোসাইন (রা) এর হাত থেকে রূপার ব্রেসলেট দুটি খুলে নিলেন। পর্দা দু’টুকরো করলেন। নবীর দরবারে সেগুলো নিয়ে হাজির
হলেন। মহানবী কন্যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে ফাতেমা, আল্লাহপাক তোমাদের জন্য নেয়ামত রেখে দিয়েছেন পরকালে। দুনিয়াতে তোমরা যেন এগুলো খরচ না কর। এসব তোমাদের জন্য নয়”।
মহানবী একজন সাহাবিকে ডাকলেন। বললেন, হে সাহাবি এগুলো অমুক গ্রামের অমুকদের সদকা করে দিয়ে আস। আর হাতির দাতের দুটি ব্রেসলেট তৈরী করে হাসান ও হোসাইন (রা) কে দিয়ে দাও। আর ফাতেমার জন্য স্বর্ণ ও রূপা ছাড়া একটি গলার হার নিয়ে আস। এভাবে মহানবী তার পরিবার-পরিজনকে দুনিয়ার প্রতি
নিরুৎসাহিত করেছেন।
আরেক হাদীসে রয়েছে: ফাতেমা (রা) কে উদ্দেশ্য করে তাঁর স্বামী আলী (রা) বললেন, ফাতেমা তোমারতো রুটির কাজ করতে করতে হাত ফুলে যাচ্ছে। পানি আনতে গিয়ে তোমার বক্ষে আঘাত লাগছে। রাসূলের দরবারে যুদ্ধ থেকে কিছু খাদেম পাওয়া গেছে। তুমি রাসূলের দরবারে গিয়ে একটি আবেদন করলে একজন খাদেম পেতে পার। একদিন রাসূলের দরবারে গেলেন মানুষের ভিড় দেখে ফিরে এলেন ফাতেমা (রা)। পরদিন আবার গেলেন। তখন মহানবী কন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন, মা ফাতেমা তুমি কিসের জন্য এসেছ? তখন তিনি চুপ রইলেন। আলী (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ তাঁর কাজ করতে গিয়ে হাতে আঘাত লাগছে, হাত ফুলে যাচ্ছে ও বুকে আঘাত লাগছে। আপনার কাছে এখন কিছু খাদেম এসে গেছে। তিনি একজন খাদেম চাচ্ছেন, যদি দিতেন-কাজের সহযোগিতার জন্য।
মহানবী (সা), কন্যাকে বললেন, “হে ফাতেমা, তুমি যদি চাও আমি তোমাকে খাদেম দিতে পারি। কিন্তু এর পরিবর্তে আমি তোমাকে একটি আমল দিতে পারি”। তখন পিতার নিকট খাদেম না চেয়ে আমল চাইলেন ফাতেমা (রা)। সাথে সাথে মহানবী (সা), ফাতেমা (রা) বললেন, প্রতি ফরজ নামাজের পর তুমি ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩বার আলহামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবর পড়। তোমার কষ্ট দূর করে দেবেন আল্লাহপাক। যা তাসবিহে ফাতেমী নামে খ্যাত। তাই আমরা ৫ ওয়াক্ত নামাজের পর তাসবিহে ফাতেমী পড়ি। প্রতিটি তাসবিহর প্রভাব আল্লাহর নিকট রয়েছে। প্রতিটি তাসবিহর বিপরীতে জান্নাতে আপনার জন্য একটি গাছ তৈরী হবে। সুবহানাল্লাহ। বাস্তবে মুমিন-মুসলমানের জন্য দুনিয়া কষ্টের। তাদের জন্য আনন্দের জায়গা পরকাল। তাই মুসলমান তথা আহলে বাইতের জন্য আদর্শ নামাজের পরে তাসবিহ পাঠ করা। ফাতেমা (রা) আদর্শ নামাজের পরে তসবিহ পাঠ করা। আল্লাহকে কেউ মেহনতের সাথে খাস নিয়তে ডাকলে তাকে সাহার্য্য করা আল্লাহর জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। তখন আল্লাহ আপনার সাহার্য্যকারী হয়ে যাবেন। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে তাসবিহে ফাতেমী আদায় করার তৌফিক দান করুন।
লেখক : ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন চট্টগ্রাম
পূর্বকোণ/আর/এএইচ