চট্টগ্রাম শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

পবিত্র হজ ও বিদায় হজের ডাক : লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক…

মনিরুল ইসলাম রফিক

৮ জুলাই, ২০২২ | ১:০৫ অপরাহ্ণ

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক……। হাজির হে মহামহিম প্রভু হাজির তোমার দরবারে। লক্ষ লক্ষ হাজী সাহেবানের এ আকুল করা তালবিয়া ধ্বনিতে হেযাযভ‚মি আজ মুখরিত। হজ ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম। হজ এর আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা। পারিভাষিক অর্থে হজের মাসে নির্ধারিত দিনে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ্ শরীফ ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ যিয়ারত ও বিশেষ কার্যাদি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করাকে হজ বলা হয়।

হজ একান্তভাবেই ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যই একজন আল্লাহতে মজনু হাজী সাহেব হজ করে থাকেন। তা সত্ত্বেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হজের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে। বস্তুত: হজের মৌসুম এমন এক বসন্ত মৌসুম, যার আগমনে নতুন প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মুসলিম উম্মাহ্। এ কারণেই হজের সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে বায়তুল্লাহ্র যিয়ারতে ছুটে আসে। যারা হজে গমন করেন তাঁরা তো ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত থাকেনই, অনুরূপভাবে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন যারা হাজী সাহেবদের বিদায় সম্ভাষণ এবং ফেরার পর অভ্যর্থনা জানায় এবং হাজীদের থেকে হজের বিস্তারিত মনমুগ্ধকর অবস্থা শুনে, তাদের মধ্যেও ধর্মীয় দিক থেকে নবচেতনার উন্মেষ ঘটে।

এমনিভাবে হাজীদের কাফেলা যে স্থান দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করে তাদের দেখে এবং তাদের লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক আওয়াজ শুনে সেখানকার কত মানুষের দিল ধর্মীয় ভাবধারায় আপ্লুত হয়ে উঠে এবং কত মানুষের অচেতন আত্মায় হজ করার উৎসাহ জেগে উঠে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিভিন্ন দেশ হতে আগত হজযাত্রীদের শারীরিক কাঠামো ভিন্ন , ভাষা ভিন্ন কিন্তু নির্ধারিত মিকাতের নিকট এসে তারা নিজেদের পোশাক পরিবর্তন করে একই ধরনের সাদা শুভ্র কাফন সদৃশ ইহরামের কাপড় পরিধান করে,তখন তাদের মধ্যে একই ইলাহ- এর বান্দা হওয়ার চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। সকলের মুখে একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে: লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক … হাজির ওহে প্রভূ আমি হাজির তোমার দরবারে, হাজির তোমার কাছে, তোমার কোন শরিক নেই, নি:সন্দেহে সমস্ত প্রশংসা এবং যাবতীয় নিয়ামতের শুকরিয়া তোমার খিদমতে উৎসর্গিত, লা শারিকালাক- তোমার শরিক, সমকক্ষ, সমমর্যাদার ও সমভক্তির আর কেউ নেই।’

তারপর মক্কা আল হারাম ও মদীনা শরীফের পবিত্র ভূমিতে কাফেলা একত্রিত হয় এবং সকলেই একই পদ্ধতিতে একই ইমামের পেছনে নামায আদায় করে। এভাবে সমবেত মুসলিম জনতা ভাষা, জাতি এবং দেশ গোত্রের কৃত্রিম বৈষম্য ভেঙ্গে দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব সংস্থাপনের বিরাট সুযোগ পায়। প্রকৃতপক্ষে, হজের এ বিশ্বসম্মিলন হল কুল্লু মুসলিমুন ইখওয়াহ ’ মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’- এর বাস্তব নমুনা। হজের মৌসুমই এ অনুভুতি উপলব্ধির হৃদয়কাড়া উৎকৃষ্ট সময়।

হজের মৌসুমে আলিম-উলামা এবং সুফী ও সংস্কারকগণ পবিত্র মক্কা ও মদীনায় একত্রিত হয়ে থাকেন। তাই এ সময় উম্মাহর সঠিক অবস্থা পর্যালোচনা করা, তাদেরকে শিরক ও বিদ’আতের অভিশাপ হতে মুক্ত করা এবং মুসলিমবিশ্বে তালিম ও তাবলীগী মিশন প্রেরণের বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া যায়। হজ যেহেতু মুসলিম উম্মাহর এমন এক বিশ্বসম্মিলন, যেখানে সব শ্রেণির মানুষই এসে সমবেত হয়। তাই এ সময় বিশ্বশান্তি স্থাপনের এবং জাতিসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব- কলহ মিটিয়ে, লড়াই ঝগড়ার পরিবর্তে ভালবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করার এক বিশ্বমৌসুম। পবিত্র হজের অনুষ্ঠানমালা ও আরাফা দিবস মুসলিম উম্মাহর এক সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ। এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর শান-শওকতের বর্হিপ্রকাশ ঘটে। মসজিদে নামিরায় যে খোৎবা উচ্চারিত হয় তাতে মুসলিম উম্মাহর ধমনিতে নতুন ঈমানী শক্তির সঞ্চার হয়, বিক্ষিপ্ত উম্মাহ হয় সুসংহত। এছাড়াও বহু কল্যাণ , উপকারিতা এবং হিকমত হজ্বের মধ্যে নিহিত রয়েছে।

উল্লেখ্য, ৮ম হিজরী সালে হুজুরে আকরাম (স.) এর মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীর সময়কালটা ছিল মুসলমানদের জন্য খোলামেলাভাবে হজের অনুষ্ঠানসমূহ পালন করার সর্বপ্রথম অবারিত সুযোগ। এ বছর হযরত মুহাম্মদ (স.) আপন সাহাবীদের সঠিক পদ্ধতিতে হজ করার শিক্ষাদান করে হযরত আবু বকরকে (রাদি:) তিনশত সাহাবীর নেতৃত্ব দিয়ে মক্কায় হজ করতে প্রেরণ করেন। ১০ম হিজরী সালে আঁ-হযরত (স.) নব গঠিত মদীনা রাষ্ট্র নিয়ে বেশ ব্যস্ত জীবন কাটান। এ বছরেই শেষের দিকে হজের সময় হলে হুজুর নিজে হজব্রত পালনের অভিপ্রায় ঘোষণা করেন। হযরতের এ ঘোষণায়, তাঁর সাথে হজে যাবার ব্যাকুলতায় পুরো মদীনা শহরের লোকজন উদ্বেল উম্মাতাল হয়ে ওঠে। তিনি রওয়ানা হয়েছেন মক্কার পানে আর তাঁর সাথে এসে মিশেছে লাখো জিয়ারতকারীর অগণিত কাফেলা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। এখানে ধনী-নির্ধন কোন ভেদাভেদ নেই, নেই মুহাজির-আনসারদের মাঝে কোন পৃথকীচিহ্ন, সবাই তাওহীদবাদী মুসলমান, সাদা শুভ্র বসনে এক আল্লাহর ঘরের মেহমান, আর তাদের সাথে আছেন আখেরী জামানার মহান পয়গাম্বর নূর নবী হযরত।

ক্রমাগত এসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এ কাফেলাটি মক্কার অদূরে জুলহুলাইফা নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করলেন। পরের দিন আবার কাফেলার যাত্রা হলো শুরু। আঁ হযরত (স.) উটের পিঠে আরোহন করেই উচ্চস্বরে হজ্বের বিশেষ দোয়া তালবিয়া পড়তে আরম্ভ করলেন। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, সম্মুখে পাহাড়পর্বত আর অনন্ত বালুকারাশির মাঝখানে মনে হলো যেন চতুর্দিক থেকেই সমস্বরে তালবিয়ার প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক…হাজির হে মহামহিম প্রভু, হাজির তোমার দরবারে…।

ইতিহাসে রয়েছে যে, মদীনা থেকে রওয়ানা হলে একাধারে দশদিন পথ চলার পর আখেরী নবী (স.) সফর সঙ্গীদের নিয়ে মক্কা মোয়াজ্জামায় উপস্থিত হন। চোখের সামনে পবিত্র কা’বা দেখতে পেয়ে নবী পাক (স.) পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে দুহাত উচু করে বলতে লাগলেন: হে রাব্বুল আলামীন,এ তোমার পবিত্র গৃহ, তুমি আপন রহমত ও মহিমায়এ ঘর উজ্জ্বল কর। আর সুখ শান্তি দান কর তাদের … যারা এই পবিত্র গৃহ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে হজ করবার জন্য আগমন করে। এরপর তিনি কাবার প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে সকলকে নিয়ে পবিত্র কা’বা ঘর সাতবার তাওয়াফ করেন। জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ পবিত্র হজ দিবসে কা’বার চত্বর আবার মুখরিত হয়ে উঠলো। সাহাবীদের সম্মিলিত লাব্বাইক ধ্বনিতে। দীর্ঘকাল যেখানে পুতুল পূজার বেসারতি চলে আসছিল আজ তা আল্লাহু আকবার (আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ) ধ্বনি—-প্রতিধ্বনিতে মুখরিতে হয়ে উঠছে বারবার, প্রতিক্ষণে।
এরপর আল্লাহর মহান পয়গাম্বর (স.) সোয়া লক্ষাধিক সাহাবীর এক বিশাল জনস্রোত নিয়ে ঐতিহাসিক আরাফাতের দিকে এগিয়ে চললেন।

বিশাল জনসমুদ্রকে সামনে রেখে তিনি জাবালে রহমত নামক পাহাড়ে দাঁড়ালেন। সমস্ত নবীরাসূল ও মহামানবদের গর্বিত উত্তরাধিকার, তামাম সৃষ্টিক‚লের পরম শ্রদ্ধার পাত্র হাবীবে খোদা হুজুরে পুর নূর (স.) এখানে রাখলেন অবিস্মরণীয় ও জগৎ বিখ্যাত ভাষণ। এতে তিনি আল্লাহরর হক ব্যাখ্যা করেছেন, মানুষের অধিকার চিহ্নিত করেছেন, অধিকার ঘোষণা করেছেন তামাম সৃষ্টির। নরনারী, দাসদাসী সবার জন্য তার দরদ যেন সেদিন উপচে পড়েছিল,। তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেউ,সেদিন মাহরুম হয়নি। আঁ হযরতের এ বিখ্যাত খোৎবা দুনিয়ার ইতিহাসের বিদায় হজের ভাষণ নামে অভিহিত হয়ে জগতবাসীকে প্রতিনিয়ত সত্য ও সাম্যের পানে ধাবিত করছে। কুরআনুল করীমের সর্বশেষ আয়াত নাজিল হয়ে সেদিন ইসলামের পূর্ণতা ঘোষিত হলো। নবীজী এ বিশাল হাজী সাহেবানদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় গ্রহণ করলেন। তাঁর নুরানী চোখ বেয়ে পড়ছে পবিত্র পানি। বিদায়ের সানাইয়ে তার বক্ষ বিদীর্ণ হচ্ছে যেন, হুজুরের হৃদয়ের এ ব্যথা, এ আকৃতি আকুলমন সাহাবীদের বুঝতে বাকী থাকলো না। হুজুর জানালেন: আল বিদা, আল বিদায় বিদায় বিদায় ওহে উম্মত সকল, ওহে জগতবাসী। সবার মুখেও সে একই সম্ভাষণ: আল বিদা, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আল বিদা, ইয়া হাবীবাল্লাহ (স.)। মহানবীর (স.) জীবনে এ ছিল সর্বশেষ হজ্ব। হে আল্লাহ! আমাদের জীবনে তোমার পবিত্র ঘরের হজ্ব নসীব কর এবং সে সাথে তোমার নবীজী হুজুর (স:) এর পাক রাওজার দামান ধরে আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা……বলে সালাম জানানোর ও জিয়ারত করার তাওফিক দান কর। আমীন।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট