চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

চিঠি

সালমা আনজুম লতা

৩ জুলাই, ২০২২ | ৫:৩১ অপরাহ্ণ

খুব ছোটবেলা থেকেই চিঠি লেখার অভ্যাস ছিল। যখন থেকে লেখা শিখেছি ঠিক তখন থেকেই। আমাদের বড়দা করাচি থাকতেন, ওখানেই চাকরি করতেন। আব্বা বলতেন, বড়’দাকে চিঠি লিখো। কচি হাতে বানান করে করে একলাইন দু’লাইন লিখতাম আর পাতা ছিঁড়তাম। বড় দাদা, সালাম নিও, কেমন আছো? কবে আসবে? ব্যস ঐ বয়সে এর চেয়ে বেশি আর এগুতে পারতাম না। কিন্তু তবুও লিখতাম। সে চিঠি পোস্ট হত কিনা জানি না। কিন্তু অভ্যাসটা তৈরি হয়েছিল তখন থেকেই। কলেজে ওঠার পর থেকে যে শুরু হল আর থামিনি। মোবাইল আসার আগ পর্যন্ত লিখেছি। ’৮৭ সালে কর্তা যখন বান্দরবান চলে গেলেন তখন সপ্তাহে তিনটা চিঠিতো লিখতামই বিনিময়ে বেরসিক কর্তার কাছ থেকে পেতাম চিঠি নয় চিরকুট।

আমার মা পড়তে জানতেন না। ওনাকেও নিয়মিত চিঠি লিখতাম। অন্য কেউ পড়ে শোনাত। মা ভীষণ খুশি হতেন। ’৭৬ সালে আমার ছোড়’দা ইউরোপ চলে গেলেন। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আপন বড় ভাইকেও এত বড় বড় চিঠি লিখতাম আর এত লম্বা উত্তর পেতাম কখনো সেই মোটা চিঠির খাম দেখলে বান্ধবীরা বলতো, ‘এই সত্যি করে বলতো মাসুদ ভাই তোর আপন ভাই নাকি কাজিন? এত বড় চিঠিতে কি লিখেরে? আমার ছোড়’দা দারুন সব চিঠি লিখতেন। সেই চিঠিগুলো এখনো সযত্নে রেখে দিয়েছি।
আমি শেষ চিঠি লিখেছিলাম ২০১৯ সালের ১লা মার্চ প্রিয় বান্ধবী Zeenat Munni সীমাকে। একান্তই ব্যক্তিগত সেই চিঠিটা সবার সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হল।

সুপ্রিয় বন্ধু সীমা,
অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম তোমাকে লিখবো। লিখবো লিখবো করেও আর লেখা হয়ে ওঠেনি। আমি তোমায় কথা দিয়েছিলাম। কোন একদিন কথায় কথায় তোমাকে বলেছিলাম, ছোট বেলা থেকেই আমার চিঠি লেখার অভ্যাস আছে। তাই শুনে তুমি বলেছিলে তোমায় লিখতে। কয়েকবার শুরুও করেছিলাম। তখন মনে হয়েছে যার সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হয় , মাঝে মধ্যে দেখা হয় তাকে আবার কি লিখবো? কি লেখা যায়? ঘুরে ফিরে জানা কথাগুলোই কাগজে লিখবো? আর সেটা তোমার পড়ে ভাল লাগবে?

হয়তো ভাল লাগতো। কোন এক ব্যস্ত দুপুরে তোমার মেইল বক্স খুলে আমার চিঠি পেতে। তুমি খামটায় তোমার নামটা দেখে চমকে যেতে। এই দিনে আবার কেউ চিঠি লেখে? চিঠি খোলার আগে খামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে প্রেরককে চেনার চেষ্টাও করতে। আচ্ছা, তুমি কি আমার হাতের লেখা চেনো? কখনো কোন প্রয়োজনে তোমাকে কিছু লিখেছিলাম? আজ একেবারেই মনে করতে পারছিনা। না চিনলেও খামটা পেলে নির্ঘাত তোমার আনন্দ হতো। চিঠি পাওয়ার আনন্দই আলাদা। কি বলো?

এবার বলো, কেমন আছো তুমি? আমি এবার আমেরিকায় এসেছি ১৭ মাস হয়ে গেলো। কত অজস্র কথা জমা হয়ে আছে। প্রযুক্তির কল্যাণে তোমার সাথে ভাইবার, মেসেঞ্জারে কথা হয়। বার্তা বিনিময় করি। তাতে যতটুকু কথা হয় তাতে যেন কোন প্রাণ নেই। নেই শারিরীক উপস্থিতি। এতদূর থেকে মনের সবটুকু আবেগ, সব কথা তোমার কাছে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। তবুও চেষ্টা করেছি।

১৭ মাস। দীর্ঘ সময়। সত্যিকার অর্থে তোমার আমার এই বিচ্ছেদ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর। সেই ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত।এই সময়টাতে আমি আমেরিকায় আসা যাওয়ার মধ্যেই ছিলাম। তোমাকে খুব মিস করেছি।কত সুন্দর ছিল আমাদের দিনগুলো। প্রায় প্রতিমাসেই আমাদের বন্ধুদের দেখা হতো। উপলক্ষ তো ছিলই। আমাদের কারো জন্মদিন, পুষ্প মেলা, বই মেলা, বসন্ত উৎসব। এমনকি ক্রিকেটের ফাইনাল খেলা দেখা পর্যন্ত। তাছাড়াও বন্ধুদের কারো ছেলেমেয়ের বিয়ে কিংবা গায়ে হলুদ। আমাদের একরকম শাড়ি পরা। কোন অনুষ্ঠানের আগের রাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করার দিনগুলো খুব মনে পড়ে। কী ছেলে মানুষই না করেছি। সবচাইতে বেশি মজা হতো কারো জন্মদিনে রাত ১২টায় ফোন করে শুভকামনা জানানোর পর্বটি।
২০১২ সালে হজ্জ্ব করে আসার পর আমি নিজেকে কিছুটা গুঁটিয়ে নিলাম। তার আগে তুমি উমরাহ করে আসলে। আমাদের জীবনযাত্রা কিছুটা পাল্টে গেলেও হৃদয়ের টান ছিল বরাবর।

আমেরিকায় আসার পর সবকিছুতেই যেন ছন্দপতন ঘটলো। ফেসবুকে আমাদের বান্ধবীদের ছবি দেখে মনে হতো, ইস কবে আবার একসাথে হবো? আবার কি ফিরে পাবো সেই দিনগুলো?

আজ ১লা মার্চ। তোমার জন্মদিন। কয়েকবছর আগের জন্মদিনগুলোতে রাতে ফোন করতাম। পরদিন সকালে আরো একবার ফোন করে কথা বলতাম। ছোট্ট একটা উপহার কিনে তোমাকে দিতাম।

এবার আমি হাযার হাযার মাইল দূরে। এই চিঠিটাই আমার সামান্য উপহার হিসেবে ধরে নাও বন্ধু। কিংবা বলতে পারো অনেকদিন আগে দেয়া আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা।

আবার যদি কখনো সময় সুযোগ আসে তাহলে তোমাকে লিখবো, মন প্রাণ ভরে। সে পর্যন্ত যেন দু’জনেই সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকি।

আমি তোমার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সম্পর্ক কখনো দূরত্বের কারণে শেষ হয়না। সম্পর্ক শেষ হয় কিংবা নষ্ট হয়ে যায় অসম্মান, অবহেলা, অহংকার , স্বার্থপরতা আর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। সেটা যেন কখনোই না হয়।
‘৭৫ সাল থেকে ২০১৯। আমাদের বন্ধুত্বের এই জার্নিটা অনেক দীর্ঘ। টিকিয়ে রেখেছি দুজনেই। আশাকরি আজীবন আমরা সুখে দুঃখে দুজন দুজনার পাশাপাশি থাকবো। শুভকামনা নিরন্তর।

লেখক: সালমা আনজুম লতা, অ্যারিযোনা থেকে

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট