চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

আত্মশুদ্ধি ও সৎসান্নিধ্য

আত্মশুদ্ধি ও সৎসান্নিধ্য

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

১১ ডিসেম্বর, ২০২০ | ৩:১৬ অপরাহ্ণ

মানুষের সকল কর্ম নিয়তের ওপর নির্ভশীল। এটি পবিত্র হাদিসের বক্তব্য। এ হাদিসের আলোকে আকিদা ও আমলগত বহু সমস্যার সমাধান দেয়া হয়েছে ইসলামি আইনে। নিয়ত মানুষের আত্মার সাথে সম্পৃক্ত। কোন কাজ করার আগে সাধারণত মানুষের মনে তার ভাব উদয় হয় অথবা সেটি প্রথমত মনে ধারণ করে।

ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেকোন কাজের মূলকেন্দ্র হলো মানুষের মন। তাই পাগল ছাড়া কেউ লক্ষ্যহীন কাজ করে না। বুদ্ধিসম্পন্ন কেউ উদ্দেশ্যহীন পথ চলে না। সুস্থ মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সব নড়াচড়া মনের সাথে একান্ত গ্রোথিত। লোভ, লালসা, কাম-মোহ, জেদ-খেদ, দীনতা-হীনতা, সংকীর্ণতা, কৃপণতা, পরশ্রীকাতরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার-অহমিকার মত যত মন্দ চরিত্র আছে সবকিছুর উৎপত্তিস্থল হলো মানুষের মন। জন্মগতভাবে মানুষ এগুলো ধারণ করে থাকে। এটাই মানবীয় দুর্বলতা। এ দুর্বলতা কেটে উঠে ‘ইনসানেকামিল’ বা প্রকৃত মানুষে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মশুদ্ধি ও সৎসান্নিধ্য প্রয়োজন। তাই পবিত্র কুরআন-হাদিসে আত্মশুদ্ধি ও সৎ লোকের সান্নিধ্যকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি আমল বা কর্মের বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা আত্মার পরিশুদ্ধির ওপর নির্ভরশীল বলা হয়েছে। আর আমলকে আরো পরিশীলিত করে নিজেকে উচুস্তরে উন্নীত করার জন্য মহৎ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

মানুষের মন্দ গুণগুলো জন্মগত হলেও ভালো গুণের বেশির ভাগই সাধনা করে অর্জন করতে হয়। সারল্য, উদারতা, বিনম্্রতা, দাক্ষিণ্য, সাহস ইত্যাদি অর্জনযোগ্য গুণ। যেমন কম বয়স্কের মধ্যে ভীতি কাজ করে। কিন্তু পরিণত বয়সে ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে তা কেটে উঠে। যুগেযুগে যাঁরাই বড় হয়েছেন, তাঁরা এগুলো জয় করেই বড় হয়েছেন।

যিনি তার আত্মাকে যতটুকু পরিশুদ্ধ করতে পেরেছেন তিনি তত বড়মাপের মানুষে পরিণত হয়েছেন। তাই মানসিক দিক থেকে বড় মানে প্রকৃত বড় লোক। মন পবিত্র মানে বাকি সব পবিত্র। কলুষিত মন নিয়ে পূণ্যের কাজ করা যায় না। তাই আমলের আগে নিয়তকে পরিশুদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। ক্বলব বা আত্মাকে ভালো-মন্দের উৎপত্তিস্থল বলা হয়েছে। পাশাপাশি এটা পরিশুদ্ধ হওয়া না হওয়াকে সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে। অপরদিকে পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী মানে সুফি। অপরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী আমলদার হলেও সুফি হতে পারেন না।

আবার পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী ব্যক্তি মন্দ কাজ করতে পারেন না। তাই যিনি যত বড় ও পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী তিনি তত বড় সুফি। সুফিগণ বাহ্যিক আমলের পাশাপাশি আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে সুফি হিসেবে পরিণত হন। এরজন্য যেমন জ্ঞানচর্চা করতে হয় তেমনি সাধনা করতে হয় নিষ্ঠার সাথে। এ ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজন কামিল ব্যক্তির ‘ছোহবত’ বা সংষ্পর্শ। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন আল্লাহর নবি (দ.) ও তাঁর সাহাবিগণ (র.)।

সাহাবি শব্দের অর্থও সংষ্পর্শ লাভকারী, যিনি পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে কামিল ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভ করেছেন এবং জাহিলিযুগ অথবা তার নিকটতম সময়ের মানুষ হয়েও অল্পসময়ের ব্যবধানে সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন। সাহাবিগণ নৈতিকতা, জ্ঞানচর্চা, সদাচরণ ও সুশাসনের জন্য বিশ^াবাসীর জন্য মডেল হয়ে আছেন। তাঁদের ঈমান ও আমল অন্যদের জন্য অনুসরণীয়। আল্লাহর নবি (দ.) তাঁদেরকে নক্ষত্রের সাথে তুলনা করেছেন।

পবিত্র কুরআনের পরতে পরতে তাঁদের প্রশংসা করা হয়েছে। এর মূল কারণ হলো, তাঁরা আল্লাহর নবি (দ.) মত সর্বোত্তম ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন। তাঁর আদর্শকে মনেপ্রাণে ধারণ করেছেন। ফার্সি প্রবাদ আছে, ‘ছোহবতে ছালেহ তুরা ছালেহ কুনদ, ছোহবতে তালে হতুরা তালেহ কুনদ’ (সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ)। আল্লামা রূমী (রহ.) হাজার বছরের লৌকিকতামুক্ত ইবাদতের চেয়ে একজন কামিল ব্যক্তির সংষ্পর্শে কিছুসময় কাটানোকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। কবি নজরুল বলেছেন, ‘ইসলাম সে তো পরশমানিক/ কে পেয়েছে তারে খুঁজি/পরশে তাহার সোনা হলো যারা/তাদেরই মোরা বুঝি’।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথী হয়ে যাও’ (সূরাতাওবা : ১১৯)। আরো বলা হয়েছে, ‘প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের জন্যে যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে, আপনি তাদের সাথে একাত্ম হয়ে থাকুন। পার্থিব জীবনের জাঁকজমকের খেয়াল যেন আপনার দৃষ্টিকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে না রাখে” (সূরাকাহাফ : ২৮)।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদিসে একটি চমৎকার উদাহরণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সৎলোক আর অসৎলোকের উদাহরণ হলো, আতর ব্যাপারী আর কামারের ন্যায়। আতর ব্যাপারী হয়ত তোমাকে বিনামূল্যে সুগন্ধি দেবে অথবা তুমি তার থেকে সুগন্ধি ক্রয় করবে অথবা অন্তত তার পাশে থাকলে তুমি সুঘ্রাণ লাভ করবে। পক্ষান্তরে কামারের পাশে বসলে হয়ত তোমার কাপড় পুড়ে যাবে অথবা তার থেকে দুর্গন্ধ পাবে” (বুখারি-মুসলিম)। মূলত এ সব কারণে ইসলামি পরিভাষায় মুরিদ-মুরশিদ তথা পীর-মুরিদ, তরিকা-তাসাউফ, ছোহবত, ফাইজ (আধ্যাত্মিকশক্তি) ইত্যাদি পরিভাষা এবং এর চর্চা চালু আছে।

তাসাউফ- তরিকতের মূলকথা আত্মশুদ্ধি। এটাকে পবিত্র কুরআনের ভাষায় ‘তাযকিয়ায়েনাফস’ বলা হয়েছে। যার অর্থ আত্মাকে বদ আকিদা ও বিশ^াস, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার-অহমিকা, সংকীর্ণতা ইত্যাদি থেকে পরিশুদ্ধ করা। বলা হয়েছে, “নিশ্চয় সফল হয়েছে সে ব্যক্তি, যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর যে ব্যক্তি সেটাকে কলুষিত করেছে সে ব্যর্থ হয়েছে’ (সূরাআশ-শামস : ৯-১০)।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে সে সাফল্য লাভ করেছে’ (সূরাআ‘লা : ১৪)। আল্লাহর নবি (দ.)-কে উত্তম ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি দুটি চরিত্রের মানুষের কথা বললেন। এক. পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী, দুই. সত্যভাষী। তিনি পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী বললেন তাঁদেরকে, যাঁদের অন্তরে খোদাভীতি ও পরিচ্ছন্নতা আছে; পাপাচারের ভাব, অবাধ্যতা ও হিংসা-বিদ্বেষ নেই (আত্তারগিবওয়াআত্তারহিব, ৪/৩৩)।

আত্মশুদ্ধির ছাড়া ‘ইনসানে কামিল’ বা পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া যায় না। কারণ, মানব-অবয়বের তিনটি অংশ তথা দেহ (জিস্ম), আত্মা (রূহ) এবং বিবেক (‘আকল) এর মধ্যে আত্মা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেহের পরিশুদ্ধির জন্য মানুষকে ‘শরিয়ত’ (বাহ্যিক বিধি-বিধান) দেয়া হয়েছে। বিবেকের পরিশুদ্ধির জন্য দেয়া হয়েছে ‘ঈমান’। আর আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য ‘ইহ্সান’-এর বিধান দেয়া হয়েছে। ইহ্সান হলো একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা ও অন্তরের পরিশুদ্ধি। এ বিষয়ক আল-কুরআনে বহু আয়াত আছে। ছহিহ বোখারিসহ বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে সংকলিত হাদিস-এ জিব্রাইল দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে ‘ইহসানের’এর স্বকীয়তা ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়েছে। উক্ত হাদিসে ইহ্সানকে দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা হয়েছে। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘তুমি আল্লাহকে দেখে দেখে ইবাদত করবে অথবা তিনি তোমাকে দেখছেন- সে মন ও মনন নিয়ে সকল কর্ম সম্পাদন করবে’।

কেউ যদি এমন পর্যায়ের বিশ^াসী ও মানসিকতা সম্পন্ন হন তাহলে ভালো কাজ তার জন্য সহজ হয়ে যায়। মন্দ কাজ অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার কাজ হয় নিখুঁত। যারমধ্যে ইহাসান ও ইখলাছ আছে তাকে শয়তান ধোকা দিতে পারে না। কুমন্ত্রণা তারমধ্যে কাজ করে না। কারণ, তিনি সর্বদা সর্বদ্রষ্টার সামনে থাকেন। তারপক্ষে দায়িত্বহীনতা, ফাঁকিবাজি, দুর্নীতি করা সম্ভব হয় না। এভাবেই বিশ^াসের দৃঢ়তা ও নিষ্কলুষতা আর কর্মের বিশুদ্ধতা অর্জিত হয়। তাই হাদিসে জিব্রাঈলের মধ্যে ঈমান-ইসলামের আলোচনার পর ইহসান-এর আলোচনা হয়েছে।

আত্মশুদ্ধি নৈতিক শিক্ষারও মূল উদ্দেশ্য। আত্মশুদ্ধি ছাড়া প্রকৃত মানুষ হওয়া যায়না। পারিভাষিক বা প্রচলিত তাসাউফ চর্চার পদ্ধতি ছাড়া আত্মশুদ্ধি করা যাবে না বা নৈতিকতাসম্পন্ন হওয়া যাবে না- এমনটি নয়। তবে যে অভ্যাস, চরিত্র বা সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করা হোক না কেন সেই অভ্যাস, চরিত্র ও সাধনার চরিত্র তাসাউফ-তরিকতের অন্তর্ভুক্ত।

বলা যায়, আত্মশুদ্ধির জন্য প্রকৃত তাসাউফ চর্চার বিকল্প নেই। কারণ, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা প্রত্যেক অঙ্গের কর্মকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে হলে প্রথমে তার আত্মকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় কলুষিত মনের বিকাশ ঘটবে তার কর্মে। ফলে অপবিত্র হবে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা বাহ্যিক আচার-আচরণ ও কাজকর্ম।

আল্লাহর নবি (দ.) বলেন, ‘শরীরের মধ্যে এমন একটি মাংসপি- আছে, যা শুদ্ধ হলে তার পুরা শরীর শুদ্ধ হয়ে যায় আর তা নষ্ট হলে পুরা শরীর নষ্ট হয়ে যায়। নিশ্চয় সেই অংশটি হলো ক্বলব তথা আত্মা’ (বুখারি, হাদিস নং- ৫২)।

 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

 

 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট