চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মিজোরাম ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

নাওজিশ মাহমুদ

১৩ নভেম্বর, ২০২২ | ৯:২৮ অপরাহ্ণ

অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে মিজোরাম যাচ্ছি। ঢাকা থেকে বিমানের টিকেট করেছি। আগতলা থেকে আইজল এবং আইজল থেকে আগরতলা। থাকবো পাঁচ দিন।

আগরতলার বন্ধুদের সকলে, আমার মিজোরাম যাওয়া নিয়ে কৌতুহল থাকলেও  নিরৎসাহিত করলো। আমার অনেক দিনের সখ মিজোরাম যাবো। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে মিজোরামের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে ভারতের মাউন্টেন ব্রিগেড এবং বিএলএফ যৌথভাবে রাঙামাটি দখল করেছিল ১০ ডিসেম্বরের দিকে। এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল মিজোরামের মহকুমা শহর ত্লাবুং এর নিকটবর্তী দেমাগিরি থেকে।

 

যদিও এই গ্রুপ কর্তৃক রাঙ্গামাটি দখলের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দ্বিধাবিভক্তির একটি আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এই যুদ্ধ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতীয় স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডার (ইনসপেক্টর জেনারেল) মেজর জেনারেল সুজন নিং ওবান এবং মুজিব বাহিনীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা শেখ ফজলুল হক মনি।

২ সেপ্টেম্বর ২০২২। সকাল ৯টায়  ভজন দত্ত গাড়ি পাঠিয়ে দিল এয়ার পোর্টে যাওয়ার জন্য। আমিও হোটেল ছেড়ে আগরতলা বিমানবন্দরে রওনা দিলাম। এর পূর্বে  আগরতলা থেকে বিমানে করে  কলকাতা গিয়েছিলাম। তখন শহর থেকে অটোরিকশাতে গিয়েছিলাম, যা বাংলাদেশে সিএনজি নামে পরিচিত। তখন রাস্তা অনেক সরু ছিল কিন্ত এবার দেখলাম প্রশস্ত রাস্তাঘাট। আগরতলা শহরের অনেক পরিবর্তন। বিমানবন্দরও  আধুুনিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। পার্কিংসহ সবকিছুতে আধুনিকতার ছাপ। বিমানবন্দর এসে বুঝলাম সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে গিয়েছি। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। যেহেতু বিমানবন্দরকে আধুনিকভাবে সজ্জিত করা হয়েছে, তাই বাথরুম থেকে পুরা পরিবেশ আন্তর্জাতিকমানের। ১২টা ৫০ মিনিটে ফ্লাইট। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর বোর্ডিংপাশের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। বিমানের আসন আরো সামনে দিলে আপত্তি আছে কিনা বিমানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলো। আমি আপত্তি নাই জানালে, আমাকে সামনে দ্বিতীয় সারিতে আসন দিল। নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হতে বেশ সময় লাগলো। 

 

এরপর বসে থাকার পালা। যথাসময়ে  বিমানে উঠলাম। দেখলাম জানালার পাশেই আসন। ছোট বিমান। মাত্র ২০ মিনিটের জার্নি। সুতরাং দ্রুত  পৌঁছে যাব। বিমান আকাশে উঠার পর দেখলাম প্রচুর কুয়াশা এবং চারিদিকে মেঘের ছড়াছড়ি। নীচে খুব একটা কিছু দেখা যাচ্ছেনা। মিজোরাম পাহাড়ের দেশ। ত্রিপুরার সমতল ভূমি পার হওয়ার পর শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড় মেঘের পর মেঘ দিয়ে ঢাকা। পাহাড়ের মধ্যে  হঠাৎ মেঘ সরে গেলে ছড়িয়ে ছিটে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। নীচে সাপের মত আকাবাঁকা নদী এবং রাস্তা দেখা যাচ্ছে। বাড়িঘর খেলনার মত লাগছে। মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যসমূহ লুকোচরি খেলার মত মনে হচ্ছিল। হঠাৎ সময় দেখলাম ২০ মিনিট অতিক্রান্ত কিন্তু আমরা এখনও আকাশে।

মনে হচ্ছিল কুয়াশার জন্য বিমান ল্যান্ড করতে পারছে না। নীচে মেঘের জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না।  প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে বিমান ল্য্যন্ড করলো। ছোট বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরটি লেংপুই নামে পরিচিত। রাজ্যসরকার কর্তৃক নির্মিত প্রথম বিমানবন্দর। রাজধানীশহর আইজল থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

 

চারিদিকে পাহাড় ঘেরা মালভূমিতে বিমানবন্দর। যেহেতু অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর তাই কাষ্টম এবং ইমেগ্রেশন থাকার কথা না। কিন্তু সেভেন সিস্টারের কিছু কিছু বিমানবন্দরে রাজ্যসরকার কর্তৃক আরোপিত ইমেগ্রশনব্যবস্থা প্রচলিত আছে। আন্দামানেও এই পদ্ধতি চালু আছে।

২০১৯ সালে আমি যখন  মনিপুর গিয়েছিলাম তখন বিমানবন্দরে সিল দিয়ে আমাকে মনিপুর ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছিল।  আইজল বিমানবন্দরেও তাই প্রত্যাশা করেছিলাম।

কিন্তু এখনকার পদ্ধতি ভিন্ন ভারতীয়দের জন্য মিজোরাম প্রবেশের অনুমিত লাগে এবং সেই সাথে ৩৫০ টাকা ফি প্রদান করতে হয়। কিন্তু বিদেশীদের ইনার পারমিট লাগে না। কোন ফি দিতে হয় না। আমার বেলায়ও কোন ফি দিতে হয়নি। শুধু আমার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পাশপোর্ট এর সাথে মিলিয়ে দেখলো। তথ্য নিয়ে একটা ফর্ম পূরণ করা হয়েছে এবং কোন স্বাক্ষরও নেয়নি।

 

ফেরত যাওয়ার কনফার্ম টিকেট প্রদর্শন করতে হয়েছে এবং তথ্যও দিতে হয়েছে। বের হযে আসলাম দেখি ট্যাক্সি কাউন্টার   বিমানবন্দর থেকে আইজলের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। ভাড়া ১৫০০ থেকে ১৬০০ নির্ধারিত। বুঝলাম এখানে পরিবহন ব্যয় অত্যধিক।  এই সময় প্রায় ২৫ বছরের একজন তরুণ ছেলে শেয়ারের যাওয়ার  প্রস্তাব দিলো।

তারা পিতাপুত্র দু’জন। যদি আমি শেয়ার করি তাহলে ৬০০ টাকা দিয়ে যেতে পারবো। সানন্দে  প্রস্তাবে রাজি হলাম। বিমানবন্দর ট্যাক্সি কাউন্টারে টাকা দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলমা। আমি সামনে বসলাম  পিতা-পুত্র পিছনে। তারা আসছে পূত্রের ব্যাংকের চাকুরীর পরীক্ষা দিতে। থাকে ত্রিপুরার ধর্মনগরে। ধর্মনগর বলায় আমি আমার বন্ধু ও দাদা প্রণব সিকদারের কথা জিজ্ঞেস করলাম, চিনে কিনা। এই প্রণব সিকদার, যার কাছে আমি বিভিন্নভাবে ঋণী। ভারতে যে কোন সমস্যায় পড়লে তিনি আমাকে উদ্ধার করেন। বললেন, চিনি।

 

উনি আমার আত্মীয়, তবে দূর সম্পর্কের। তিনি ফোন নং আছে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমি ফোন নং দিলাম। তিনি ফোন করে বললেন আমি পাপলির স্বামী। বুঝলাম শশুরবাড়ির দিক থেকে আত্মীয়। উনার সাথে  আলাপ জমে উঠলো। বললেন, ড. ইউনূসের সাথে একটি সেমিনারে দেখা হয়েছিল। এটা নিয়ে খুব গর্ব করতে দেখলাম। উনারা একটি হোটেলে আগে থেকে বুক করে রেখেছেন। আমি কোন হোটেল বুক করিনি। উনার সাথে ঐ হোটেলে গিয়ে যদি থাকার ব্যবস্থা হয়, তা হলে থাকবো নতুবা অন্য হোটেলে উঠবো।

পাহাড়ী রাস্তা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আইজল পৌঁছে গেলাম। কোন সমতল ভূমি নেই। পুরা পাহাড়ের উপর শহরটি গড়ে উঠেছে। কোন পাহাড় না কেটে রাস্তা বাড়িঘর তৈরি করেছে। দেখতে অপূর্বই লাগে। দূর থেকে মনে হয় পাহাড়ের কোলে বিভিন্ন রঙ্গিন ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে শহরে পৌঁছলাম।

 

সফরসঙ্গীদের বুক করা হোটেলে থাকার জন্য কোন  রুম পেলাম না। তবে হোটেলের মালিক ফোনে কথা বলে তারই আত্মীয়ের মালিকানাধীন আরেকটি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। একই ট্যোক্সিতে করে এই হোটেলে চলে আসলাম। তবে এইগুলিকে পেশাদার হোটেল না বলে নিজেদের থাকার ঘরের একটি অংশ ভাড়া দিয়ে  হোটেল হিসেবে ব্যবহার করছে। যা সাধারণ হোম স্টে নামে পরিচিত। 

একজন তরুণ আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমকে রুম দেখালো এটাচ বাথরুমসহ একটি ডবল বেডের রুম। আমি কোন সিঙ্গেল খাটের কোন রুম আছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। বললো আছে কিন্তু বাথরুম এটাচ না, তবে রুমসংলগ্ন। অন্য কেউ ব্যবহার করবে না। বাথরুম তালা দেয়া থাকবে। চাবি আপনার কাছে থাকবে। ভাড়া সামান্য কম।  রুম দেখে আমার পছন্দ হলো। আমি  সিঙ্গেল রুমে উঠে গেলাম। সাথে কিচেনও আছে। আমি চাইলে কিচেনও ব্যবহার করতে পারবো।

 

একটি বড় খোলা জায়গায় ড্রইং ও ডাইনিং টেবিল। সোফাসেট আছে। আছে কয়েকটি টেবিল খাওয়ার জন্য। চারিদিকে আমারটাসহ পাঁচটি  রুম। ঢুকতে তিনটি রূম। বড় বেলকোনিও আছে। বেলকোনিতে বসার জায়গাও আছে সবার জন্য।  সেখানে চেয়ার টেবিলে বসে চা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। কিচেনে চাউল, মসল্লা, চিনি, লবন, প্লেট , দুধ, চা পাতাসহ রান্নার সরঞ্জাম সককিছু আছে। কেউ চাইলে রান্না করে খেতে পারবে। তবে তার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে কি না  জিজ্ঞেস করা হয়নি।

হোটেল মালিকের পরিবার তিনতলায় থাকে। নীচতলায় ডিপার্টমেন্ট স্টোর। দু’তলায় হোটেল। আমি যে রুমে উঠলাম মাত্র ১ জনের থাকার উপযোগী। সেখানে টি টেবিল, একটি চেয়ারসহ টেবিল পরিধেয় কাপড় রাখরা জন্য আলমিরা সবই আছে। একটি জানালা দিয়ে বাইরে দেখার সুযোগও আছে। তবে সবচেয় সুন্দর হলো ডাইনিং ও ড্রয়িং সংলগ্ন কমন বেলকোনি থেকে পাহাড়ে বাড়িঘর দেখার অপূর্ব সুযোগ। মাঝখানে নীচে অনেক দূরে ঘরবাড়ি দেখা যায়। চারিদিকে পাহাড়। আমি যে হোটেলে উঠেছি এটাও পাহাড়।

 

সেখান থেকে দূরে ও আশেপাশে পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। যা দেখে মন ভরে যায়। শুধুু বসে থাকতে ইচ্ছা করছে। নীচের তলায় ডিপার্টমেন্ট স্টোর একই মালিকানায়। যে ছেলেটি আমায় বরণ করে নিল। রুম দেখিয়ে দিল, সেই এই হোটেল দেখাশুনা করে। এই হোটেলসহ বিল্ডিং এবং ডিপার্টমেন্টাল স্টোর তাঁদের পরিবারের সম্পত্তি। তরুণটির নাম হেরি। মিজোরামের অধিকাংশ লোক খ্র্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী। তরুণটির বয়স প্রায় ৪০।

লেখাপড়া করেছে তাইওয়ান, ইউরোপ ও  অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়া থেকে এমবিএ করেছে। তার পিতা ভারতে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দিয়েছিল আইপএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করে সর্বশেষে মহারাষ্ট্র থেকে ডিআইজি হিসেবে অবসর নিয়েছেন। সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশও ভ্রমণ করেছেন। হেরিকে জিজ্ঞেস করলাম সে কি বিবাহিত। বলল, না। আমি অবাক হলাম। কারণ বললো পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে মিজোরাম জনগোষ্ঠী থেকে বিয়ে করতে হয়। সে ইউরোপের একটি মেয়ের সাথে প্রেমের বাঁধনে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরিবারের ঐতিহ্য রক্ষার্থে এবং পরিবারের সম্মতি না মিলাতে সে বিয়ে করতে পারেনি।

লেখক: নাওজিশ মাহমুদ, রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট