চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সামাজিক অবক্ষয়ের অপর নাম যৌতুকপ্রথা

সৈয়দা সারওয়ার জাহান

২৩ মে, ২০২২ | ১১:৫৬ অপরাহ্ণ

যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপ। আমাদের সমাজে অনেক প্রথা আছে, যা মানুষের জন্য অকল্যাণকর। যৌতুকপ্রথা সেসব প্রথার মধ্যে নিকৃষ্ট এবং বর্জনীয়।

ইসলাম যৌতুককে সমর্থন তো করেই না বরং বিয়েতে স্ত্রীর জন্য মোহরানা পরিশোধের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইসলামে মেয়েদের সম্পত্তির অংশীদার করা হয়েছে। মেয়েরা মুসলিম আইনানুযায়ী পৈতৃক সম্পত্তি এবং স্বামীর সম্পত্তির ওপর অধিকার অর্জন করে। মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর সংসারে গিয়ে অনেক সময় পৈতৃক সম্পত্তির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে না। কিন্তু সম্পত্তির অধিকার কখনো ক্ষুণ্ন হয় না। প্রয়োজনে সে সম্পত্তি যেকোন সময় পেতে পারে।

যেসব ক্ষেত্রে পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি অস্বচ্ছল ভাইদের কাছে থাকে, বোনদের অবস্থা যদি অপেক্ষাকৃত ভালো হয় এবং তাদের স্বামীরা যদি সেটা মেনে নেয় তখন মেয়েরা সে সম্পত্তি নেয় না। বর্তমানে এই সংখ্যা একেবারেই নগন্য। কারণ স্থাবর সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামের জমিও এখন বহুমূল্যবান সম্পত্তি। অনেক সময় মেয়েরা বা তাদের স্বামীরা ছেড়ে দিলেও সন্তানরা কোনভাবেই ছাড় দিতে চায় না। আমার জানা মতে এমন ও ঘটনা আছে যেখানে মায়ের সন্তানরা বিশেষ করে ছেলেরা নানার সম্পত্তির জন্য মামাদের চরম অসম্মান করেছে; তাদের ভিটা বাড়ির অংশ পর্যন্ত কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিয়েছে। স্বনামধন্য মামাদের জিম্মি করে সম্পত্তির বাইরেও অন্যান্য জিনিস দাবী করে একপ্রকার জুলুম করেছে।

প্রসঙ্গ ছিল যৌতুক নিয়ে কথায় কথায় বললাম এই বিষয়টা যা আসলেই একটি সত্যি ঘটনা এবং বেশিদিন আগের নয়। এই বিষয়টা উত্থাপন করার প্রথম কারণ হলো, অনেকের মুখে এমন কথা ও শোনা যায়, বিয়ের পর স্বামীকে ভরণপোষণ দিতে হয় বলে বাপের বাড়ি থেকে মেয়ের সাথে মূল্যবান সামগ্রী অর্থসম্পদ দেওয়াটা সমীচীন। দ্বিতীয় কারণ হলো হিন্দুমেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তিতে ছেলেদের মত ভাগ পায়না বলে তাদের মধ্যে এই পণ বা যৌতুকপ্রথার প্রচলন হয়।

প্রথমত, বলবো ইসলামধর্মের বিধান অনুযায়ী মেয়েদের জন্য সম্পত্তির অংশ ভাইদের অর্ধেক পরিমাণে থাকে। পবিত্র কোরআনে সূরা নিসার ১১ ও ১৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে একজন পুরুষের অংশ দুইজন নারীর সমান, মুসলিম ফারায়েয আইন কোরআনিক আইন অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়েছে। তাই এখানে কোন বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। বিয়ের সময় মেয়েদেরকে মূল্যবান সামগ্রী বা অর্থসম্পদ দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু সমাজে এটি একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে। বিয়ের সময় কী দিয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে এ কথা সবার মুখে মুখে থাকে। ছেলের মা-বোনেরা, চাচি, মামি-খালারা বেশি বলে এ সব কথা।

নতুন বউকে দেখতে আসলে কেউ না কেউ তাকে যেকোন ভাবে এসব কথা শুনিয়ে দেয়। নতুন বউ যেন বোবা পুতুল, সে যে শিক্ষিত বা বুদ্ধিমতী, সে কথা বলতে পারে, জবাব দিতে পারে, তাদের বলা কথা গুলো বউ গিয়ে বাপের বাড়িতে বলে দিতে পারে এসব  বিষয় তাদের মাথায় থাকে না। তারা বরপক্ষের হিতৈষী হয়ে বিভিন্ন কাহিনি শোনাতে থাকে। কার বউ এর বাপের বাড়ি থেকে কী কী দিয়েছে ইত্যাদি। তখন নববধুর অবস্থা কি হতে পারে তাও তারা চিন্তা করে না। সমাজে যৌতুকপ্রথা একটা অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছে বলেই বরপক্ষের এই সমস্ত কথা কনেকে বা কনেপক্ষকে শুনতে হয়।

একটা সংসারে যত্নে লালিত একজন কন্যা সন্তানকে তার পিতামাতা যখন অচেনা একটা পরিবারে পাঠিয়ে দেন তখন তাদের হৃদয় খান খান হয়ে যায়। মেয়েটির ও নতুন জায়গায় নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাওয়ানোটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়ে যখন আত্মীয় স্বজন বা পরিবারের সদস্যরা তার বাপের বাড়ির খোঁটা দিয়ে তাকে জর্জরিত করে; সরাসরি বলতে না পারলে পরোক্ষভাবে বলে, আবার একটু দূরে গিয়ে শুনিয়ে ও বলে, যাতে মেয়েটি তার বাপের বাড়িতে শেয়ার করতে পারে। এতকিছু শোনার পর স্বাভাবিকভাবেই শ্বশুরবাড়ির প্রতি তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হবে।

এসব ঘটনা মেয়েরা বাপের বাড়িতে সবসময় বলে না। নিজের কষ্টটা নিজের মধ্যেই রাখতে চায়, একেবারে অসহ্য হলে বলে। তখন বাপের বাড়ি থেকে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখানো হয় অথবা মেয়েকে প্রবোধ দেওয়া হয়। প্রতিক্রিয়া দেখালে বা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির মুখোমুখি হলে কোন লাভ হয় না বরং তিক্ততা বাড়ে, কেউ কেউ নীরবে আবদার পূরণ করে যান। আর যখন অন্যায় আবদারগুলো পূরণ করা হয় তখন বরপক্ষ ধরে নেয় যে, দাবি করে তারা কোন অন্যায় করেননি। এরপর উত্তরোত্তর দাবির পরিমাণ বাড়তে থাকে। মেয়ের বাপ মা হলে তাদেরকে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, বিয়ের পর ও জামাই এর অযাচিত আবদার পূরণ করার দায় ও বহন করতে হবে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা বা অভিভাবককে, এটাই এখন রেওয়াজ হয়ে গেছে সমাজে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই আবদারের ধরন ও বিভিন্ন রকম হয়। উচ্চবিত্তদের মধ্যে আকারে ইঙ্গিতে দাবি বা পাওনার কথাগুলো বলা হয়। বিষয়টা অনেকটা ‘আকলমান্দকে লিয়ে ইশারাই কাফি’ এমনই একটা ভাব থাকে। তখন মান বাঁচাতে আগে ভাগে দাবি পূরণ করে দেন কনের পিতা-মাতা। অতি উচ্চবিত্তরা বলার আগে স্বপ্রণোদিত হয়ে এত বেশি কিছু দিয়ে ফেলেন যে, তখনবলার কোনো অবকাশ থাকে না। এটি একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা বলা যায়; কে কত বেশি দিতে পারেন, কত বেশি খাওয়াতে পারেন এবং জাঁকজমক করতে পারেন, অঢেল অর্থ ঢেলে দিয়ে তাঁরা এটাই করেন।

এতে সমাজে খারাপ নজির সৃষ্টি হয়েছে যার প্রভাব সাধারণ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের মধ্যে পড়েছে। অথচ ওই অর্থ দিয়ে ইচ্ছে করলে অনেকগুলো দরিদ্র পরিবারে স্বচ্ছলতা আনার ব্যবস্থা করা যায়, অনেক ভিক্ষুককে, বেকারকে কর্মসংস্থান করা যায়। অথবা অন্য যেকোন কল্যাণমূলক কাজে ব্য্য করা যায়, তাতে ইহকাল ও পরকালের মঙ্গল বয়ে আনে।

বিয়ের লেনদেনের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের মধ্যে মধ্যমপন্থা বা চরমপন্থা অবলম্বন করা হয়। যেমন: বর বা বরের পিতৃপক্ষ প্রথমে ভদ্রভাবে প্রয়োজনের কথা বললেও দাবি না মানলে অভদ্র হতে সময় লাগে না। ভিকটিম মেয়েটি মানসিক, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে একসময় আত্মহননের পথ ও বেছে নেয়। এভাবে তারাচরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে শাস্তির হাত থেকে ও বেঁচে যায়। কারণ অনেক সময় আইনের আশ্রয় নেওয়া হয় না। আইনের আশ্রয় নেওয়া হলেও প্রমাণ করা অনেক কঠিন ও সময় সাপেক্ষ হয়।

যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ এর ৪ ধারা অনুসারে “প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যদি কোন পক্ষ অপর পক্ষকে বিয়ের আগে বা পরে বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে যে কোন সময় যে কোন সম্পদ বা মূল্যবান জামাণত হস্তান্তর করে বা করতে সম্মত হয় সেটাই যৌতুক বলে বিবেচ্য হবে। যৌতুক দেয়া বা নেয়া উভয়ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে এক থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় দ- হতে পারে’। যৌতুক দাবি করার জন্য ও একই সাজা হতে পারে। যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ বাতিল করে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে।

এখানে শাস্তি আর কঠোর করা হয়েছে। এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, যদি বিবাহের কোন পক্ষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বিবাহের অন্য কোন পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন, তাহা হইলে উহা হইবে এই আইনের অধীন একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৫(পাঁচ) বৎসর কিন্তু অন্যূন ১(এক) বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

হিন্দুসমাজে নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে পুরুষদের মত সম্পত্তি লাভ করতে পারত না বলে হিন্দু আইনে যৌতুককে নারীর সম্পত্তির (স্ত্রীধন) উৎস হিসেবে উল্লেখ থাকায় স্মরণাতীত কাল থেকে হিন্দুসমাজে যৌতুক বা বিয়েতে পণপ্রথা চালু হয়। তবে, এটি নিরুৎসাহিত করার জন্য ১৯৩৭ সালের হিন্দুনারীর অধিকার আইনে হিন্দুবিধবাকে তার স্বামীর সম্পত্তিতে সন্তানের সমপরিমাণ অংশ পাওয়ার অধিকার সীমিতভাবে দেওয়া হয়।

তবে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন ১৯৫৭ তে সনাতন উত্তরাধিকার ব্যবস্থা বাতিল করে মৃতব্যক্তির পুত্র ও কন্যারা পিতা বা মাতার সম্পত্তির সমান অংশ পাওয়ার অধিকার পায়। এতদসত্ত্বেও বিয়ের পণপ্রথা বন্ধ না হওয়ায় বিয়ের সময় যৌতুক দাবি করা বা গ্রহণ করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৬১ জারি করা হয়। এ আইনে বর্ণিত যৌতুকের জন্য শাস্তি ছয়মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচহাজার রুপী জরিমানা বা উভয়বিধ দণ্ড।

আইন প্রণয়ন করে যৌতুকপ্রথা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। বরং মানুষের লোভ-লালসার কাছে পরাজিত মনুষ্যত্ব যৌতুকপ্রথাকে লালন করেছে। ফলশ্রুতিতে যৌতুক দাবির পরিণতিতে নারীর উপরে নির্যাতন অব্যাহত থাকে। বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হয় নারী, এমনকি অবলীলায় খুন ও হয়ে যায়। সরকার ১৯৯৫ সালে আরো কঠোর আইন জারি করে। এ আইনে যৌতুকের দাবিকে কেন্দ্র করে মহিলা বা শিশুকে সামান্য বা গুরুতর জখম করা, হত্যার চেষ্টা করা বা হত্যা করার জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়।

এই আইনটি ও অপরাধ দমনে যথেষ্ট বিবেচিত না হওয়ায় এটি বলবত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (নির্যাতনমূলক শাস্তি) আইন ২০০০ জারি করা হয়। ২০০৩ সালে এই আইনটি সংশোধন করে যৌতুকের দাবি নিয়ে হত্যার দায়ে মৃত্যুদ-, হত্যার চেষ্টা চালানোর জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড, মারাত্মক জখম করার দায়ে ১ থেকে ৩ বছরের কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। 

লেখক:  চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) বাংলাদেশ রাবার বোর্ড

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট