চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সৌভাগ্য রজনীতে ইবাদত বন্দেগী

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৮ মার্চ, ২০২২ | ৮:১৩ অপরাহ্ণ

আজ দিনের অবসানে পবিত্র লাইলাতুল বারাআত। আমাদের দেশে এ’টি শবে বরাত নামে বিখ্যাত। শ’ব ফার্সী শব্দ। অর্থ রাত, আর বরাত মূলত আরবী শব্দ, অর্থ সৌভাগ্য,বন্টন নিষ্কৃতি, মুক্তি ইত্যাদি।

হাদীস শরীফে এ রাতের অফুরন্ত ফজিলতের কথা বিঘোষিত হয়েছে এবং এটির নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল নিসফ মিন শাবান বা শাবানের রজনী। হযরত আয়েশা (রাদি.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসের মাধ্যমে জানা যায়, তিনি বলেন: আমি এক রাতে মহানবী (স.)কে যথাস্থানে না পেয়ে খুঁজতে থাকি। হঠাৎ দেখি তিনি সিজদারত। কিন্তু তার দীর্ঘক্ষণ সিজদাবনত অবস্থা দেখে আমার মনে এ সন্দেহ হয় যে, হয়তো হযরতের প্রাণবায়ু বের হয়ে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি এসে তাঁর পায়ের বৃৃদ্ধাঙ্গুলী ধরে নাড়া দিলাম। ক্ষণিক পরে তিনি উঠে পড়েন। এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন: হে আয়েশা! তুমি কি জান না আজ কোন রাত? আজ তো লাইলাতুন নিসফ মিন শা’বান।

উল্লেখ্য, আরবী শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিনগত ১৫ তারিখ হলো পবিত্র শবে বরাত বা সৌভাগ্য রজনী। মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন: এ রাত গুণাহ মাফের রাত। তবে সাত প্রকারের মানুষকে এ রাতেও আল্লাহ ক্ষমা করেন না। যেমন- নেশাদার, শরাব পানকারী, পুন: পুন: ব্যাভিচারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, চোগলখোর, কৃপন ও এমন মুসলমান যে অন্য মুসলমানের সাথে রাগস্বরে তিন দিনের চেয়ে অধিক সময় পর্যন্ত কথা বলা বন্ধ রাখে।

রাসূলে খোদা (স.) এর হাদীস শরীফে শুধু এ রাতকেই নয়, এ রাতকে বহনকারী গোটা মাসকেই তিনি তা’জীমের সাথে অতিবাহিত করতেন। এ মাসে তিনি বেশি বেশি পরিমানে রোজা রাখতেন, জিকির আজকার ও নফল নামায পড়তেন। সাহাবাগণ একবার জানতে চাইলেন: হে আল্লাহর রাসূল (স.) ! আমরা আপনাকে শাবান মাসের মতো আর অন্য কোন মাসে এতো বেশি রোজা রাখতে দেখিনা। (এর কারন কি?) হযরত জানালেন- এ মাসে আল্লাহ তায়ালার নেক বান্দাদের আমল আল্লাহর দরবারে আলীশানে জমা হয়। আমি চাই আমার হিসেব-নিকেশ আল্লাহর কাছে পৌঁছার মুহূর্তে আমি রোজাদার হিসেবে থাকি। এ প্রসঙ্গে মহানবী (স.) আরো বলেছেন: যে ব্যক্তি এ মাসে তিনটি রোজা রাখবে আল্লাহ পাক তাকে সারাবছর রোজা রাখার সমপরিমাণ সাওয়াব দান করবেন। তিনি আরো বলেছেন: (নাক্কু আবদানাকুম বি সাউমি শাবান ………) অর্থাৎ তোমরা শাবান মাসের রোজা রাখার মাধ্যমে রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য শরীর মন পবিত্র কর।’ হুজুরে পুরনূর (স.) এ মাসের সিয়াম পালনকে রমজানে ফরজ সিয়াম পালনের মহড়া হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন।

এ সব ক্ষেত্রে রোজা পালনের গুরুত্বটা বেশ করে তুলে ধরা হয়। এর কারণ হলো একমাত্র রোজা বা সিয়াম পালনের মাধ্যমেই দিনের ২৪ ঘণ্টার সার্বক্ষণিক মনমেজাজ আল্লাহর একনিষ্ঠ ধ্যানে নিমগ্ন করা সম্ভব। একজন রোজাদার দিনে রাতে সাহরী ইফতারীতে কাজে কামে সর্বাবস্থায় আল্লাহ পরওয়ারদিগারের অবিরাম স্মরণের সুযোগ পান। এ জন্য আমরা এ শাবান মাসে এ বরাত রজনীতে সিয়াম-কিয়াম, রুকু-সিজদা, তাসবীহ-তাহলীল, তিলাওয়াত জিকির ইত্যাদির মধ্যে আত্মনিয়োগ করবো।

নামাজ রোজা ও তিলাওয়াতে কুরআন সর্বোৎকৃষ্ট ইবাদত। কুরআনে এসেছে- ইস্তাঈনু বিস সাবরি ওয়াসসালাহ অর্থাৎ তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মধ্য দিয়ে (আল্লাহর) সাহায্য প্রার্থনা কর।’ আজকাল নামাজ আছে ধৈর্য নেই। ইবাদত আছে প্রাণ নেই, শবে বরাত আছে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নেই। এ জন্য আমাদের দোয়া আমাদের মুনাজাত কবুল হয় না। আর আমরা দোষ দেই ভাগ্যের অথচ আমরা যদি শরিয়তে নির্দেশিত পন্থায় আল্লাহকে ডাকি, তাকে স্মরণ করি, তার কাছে সাহায্য চাই, ক্ষমা ভিক্ষা করি তাহলে তিনি অবশ্যই বান্দাকে নিরাশ করবেন না। তিনি আল-কুরআনে দৃঢ়তার সাথে ঘোষনা করেছেন: উদঊনী আস্তাজিবলাকুম’- হে বান্দা সকল! তোমরা আমায় ডাকো, আর আমি তোমার ডাকে অবশ্যই সাড়া দেই।

এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ব্যাখ্যা এসেছে এভাবে: কোন কোন মানুষ হারাম খায়, হারাম পরিধান করে তারপর আল্লাহকে ডাকে। তাহলে এ অবৈধ ‘ডাক’ বা মুনাজাত আল্লাহ কিভাবে শুনবেন? (তা মা’রিফুল কুরআন)। বলা হয়েছে- ক্বদ আফ লাহা মান তাঝাক্কা- সে-ই তো সফলকাম হয়েছে যে তনমন পবিত্র করে নিয়েছে। আঁ হযরত (স.) সুন্দর বলেছেন: ছালাছা আসওয়াতিন ইউহিব্বুহাল্লাহু অর্থাৎ তিন প্রকারের আওয়াজ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার অধিক পছন্দ। তন্মধ্যে- ১) মোরগের ডাক (কারণ সে প্রত্যুষে আল্লাহর নামে ডাক দিয়ে মানুষের ঘুম ভাঙ্গায়। ২) কুরআন তিলাওয়াতকারীর কণ্ঠ (কারণ ঐ কণ্ঠে আল্লাহর বাণী ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়। ৩) আর ঐ ব্যক্তির সুর যে ব্যক্তি শেষরাতে আল্লাহর ধ্যানে (যখন সারা দুনিয়া ঘুমের ঘোরে অচেতন) করুণ ও আবেদনময় সূরে তার ইবাদত বন্দেগী করে।’

শেষরাতে আল্লাহর বন্দেগী করার সুযোগ এনে দেয় শবে বরাত। এ রাতের শেষ অংশে জেগে ইবদাত করার জন্য আমরা হাদীসের বর্ণনার মাধ্যমে উৎসাহ পেয়ে থাকি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন: এ রাতে মহান প্রভূ আল্লাহ তায়ালা সপ্তম আসমান থেকে নিম্নতম আসমানে (সামা-ই-দুনিয়া) নেমে আসেন এবং ডাকতে থাকেন: আছো কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী ? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছো কি কেউ সাহায্য প্রার্থনাকারী ? আমি তাকে সাহায্য করবো। আছো কি কেউ বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে বিপদমুক্ত করবো।

আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন আল্লাহর হাবীব, মাহবুব। তিনি ছিলেন নিষ্পাপ, মাসুম। উপরন্তু তাঁর পবিত্র হায়াতে তায়্যিবাহ এতো বেশি সুবিন্যাস্ত ছিল যে, এখানে গুণাহ করার কোন মওকা ছিল না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও  আঁ হযরত (স.) হাজারো কর্মব্যস্ততার মাঝে শাবানকে অতি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতেন এবং এ মাসের ইবাদত রিয়াজতগুলো কামা হাক্কাহু যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে সচেষ্ট থাকতেন। তিনি মুনাজাতে বলতেন:  আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রজাবা ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিাগানা রমাজান অর্থাৎ হে মহামহিম প্রভূ আল্লাহ! আমাদের জীবনে রজব ও শা’বান মাসের বরকত দাও এবং আমাদেরকে পবিত্র রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।

আজকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হব যে, শাবান এবং বিশেষত: শ’বে বরাতকে অতি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর পরিবেশে আমরা অতিবাহিত করার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেব। আর প্রকৃত ইবাদতের মাধ্যমে মেহেরবান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াস চালাবো। এ’ দিনে আমরা ইবদতের নামে ধর্মের নামে ইসলামের নামে এমন কোন কাজ করবো না, এমন আবেগের আশ্রয় নেবনা যার দ্বারা ইসলামের পবিত্রতা ও সত্যতা ক্ষুন্ন হয়, শবে বরাতের গুরু গম্ভীর স্বর্গীয় পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। শবে বরাত উপলক্ষে আমরা দেখি আমাদের সমাজে উন্নত মানের খানাপিনা ও হালুয়া রুটিই প্রাধান্য পায়। এসব যারা বেশি পরিমাণ আহার করে তারা যেমন ইবাদতে ঝিমিয়ে পড়ে তেমনি যে সব মহিলা এর আয়োজনে ব্যস্ত থাকে তারাও ইবাদতের ফূরসৎ হারিয়ে ফেলে। আমরা যেন এ রাতকে শুধু খানাপিনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখি।

তবে এ রাতে ঐ খানাপিনাই কাম্য, ঐ দান-সদকাই কাম্য-যা কিনা গরীব মিসকিনদের মুখে হাসি ফুটায়। এ ছাড়া শবে বরাতের মতো একটি অতিপূণ্যময় রাতে এক শ্রেণির শিশুকিশোর পটকা ফুটানো ও আতশ বাজি পোড়ানো ইত্যাদি নিয়ে মেতে উঠে। যা অত্যন্ত দু:খজনক ও লজ্জাকর। শবে বরাতসহ বছরের অন্যান্য আরো যে ৪টি রাত অতি পূণ্যময় হিসেবে বিখ্যাত (যেমন- শ’বে মিরাজ, শ’বে কদর ও দুই ঈদের রাত) এগুলোর তুলনায় শ’বে বরাতকে ঘিরে এক শ্রেণির অতি উৎসাহী মুসলমান বেশি বাড়াবাড়ি করে কুসংস্কার ও অজ্ঞতায় মেতে উঠে। আমাদেরকে আসল সহজ ও সরল পন্থায় ইসলাম ধর্মের কল্যাণ হাসিল করে ইহ-পরজগতে সৌভাগ্যবান হতে হবে ইনশা আল্লাহ।

লেখক: মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত খতীব

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট