চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মুজিবশতবর্ষে অন্তরের আকুতি

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

১৮ মার্চ, ২০২০ | ১:৪৫ পূর্বাহ্ণ

মুক্ত মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধি নিয়ে সারা বাংলার মানুষের মনিকোঠায় আসন করে নেন। সমসাময়িক সিনিয়র-জুনিয়র নেতা-নেত্রীকে ছাড়িয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হন। মুজিব খোকা, তরুণ, যুবক থেকে একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে পরিণত হন। বাঙালি জনমানুষের মুক্তির দূত হিসেবে নিজেকে, নিজের ইতিহাসকে ছাড়িয়ে যান।
অতঃপর ভঙ্গুর পাকিস্তানের কবর রচনা করার উত্তাল মার্চে জাতির উদ্দেশ্যে বিশ্বনন্দিত ভাষণের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তির দ্বার উম্মোচন করেন। এভাবেই আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে বিশ্ব ইতিহাসের অবিসংবাদিত, অনিবার্য নেতায় পরিণত হন শেখ মুজিবুর রহমান। নয় মাস পাকিস্তান কারাগারে আটক থেকে, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ভোগ করে, ইস্পাত কঠিন মনোবল ধারণ করে নিজেকে বাঙালির দৃশ্যপট এবং মানসপটে অনিবার্য করে তোলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির, বাঙালিত্বের, বাঙালি জাতিসত্তার সম্মানকে চিরস্থায়ী আসন করে দেন সমসাময়িক ও অনাগত ভূখ-ে। অতঃপর বীরের বেশে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা ফিরে আসেন দেশের মানুষের মাঝে বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে।
বঙ্গবন্ধু প্রথম দেশে ফেরেন আটচল্লিশ বছর আগে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তিন বছর সাত মাস ক্ষমতায় থেকে তিনি বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন। সোয়া দুই বছরের মাথায় পৃথিবীর ১২১ টি দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি আদায় করেন। পরপর দু’বার চীনের ভেটো সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৩৬ তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে যোগদান করে বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯ তম অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর দেশেবোধের, দেশাত্মবোধের, জাতীয়তাবোধের সর্বোত্তম প্রকাশ।
দেশ গঠনের কঠিন সংগ্রামে লেগে থাকার সময় তাঁকে হত্যা করা হয়। প্রিয় স্বদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার কঠোর-কঠিন সংগ্রামে যখন তিনি লিপ্ত, যখন তিনি কঠোর পরিশ্রম করে চলেছিলেন স্বপ্ন ধরার প্রত্যয়ে, যখন আন্তর্জাতিক পরিবেশের রক্তচোখ, ষড়যন্ত্র, অসহযোগিতাকে উপেক্ষা করে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালোবাসাকে সম্বল করে তিনি দেশকে তিল তিল করে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টায় রত ছিলেন। তখনই তাঁকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। হত্যা করা হয় পরিবারের অনেক জনকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের নীল নকশায় এদেশের মানুষ তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে নিপীড়িত মানুষের শুভেচ্ছার বার্তাবাহক, বিশ্বশান্তির জুলিও কুরি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এদেশে এসেছিলেন দেশের পুনর্গঠনের জন্য। দেশের মানুষের ভালবাসাকে তৃপ্তিসহ ভোগ করে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তাদের দেশপ্রেম, শ্রম ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মানসে। স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
এরপরে তাল বেতাল, চেতনাহীন পথচলার প্রায় ২১ বছর। সামরিক চক্র, বাম-ডান চক্র তখন দারুনভাবে সক্রিয়। তারা পাকিস্তানি কায়দায় মুজিবের চেতনাকে নির্বাসনে পাঠায় নিরলসভাবে, নির্দ্বিধায়, নির্লজ্জের মত। দেশে নিষিদ্ধ হয়ে যায় জয় বাংলা স্লোগান, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চা। প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যায় পাকিস্তানি ভাবধারা, সনাতনী মৌলবাদী চেতনা এবং সাম্প্রদায়িকতার সামাজিক প্রক্রিয়া। হতাশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসম্প্রদায়িকতার বোধ । স্বসত্তায়, অবয়বে, নিজ আবাসে বন্দি চেতনাগুচ্ছ হাহাকার করে, বিলাপ করে। পাকিস্তান ফেরত সেনাদলের চেতনাধারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় শাসন-শোষণ সামাজিকতা এবং সংস্কৃতির বোধ বিবেক অনেকাংশ, সর্বাংশে। প্রতিহিংসার, অনৈতিকতার আন্ত ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বৃহৎ শক্তি চীন স্বীকৃতি দেয় আরো দশ দিন পর অর্থাৎ ২৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়াটাই ছিল যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমার্জনীয় অপরাধ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান ফেরত সেনানায়ক এরশাদ প্রথমে সেনাবাহিনীপ্রধান এবং পরবর্তীতে দেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ক্ষমতা দখল করেন। সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান তাকে বিভিন্নভাবে প্রভাইড করেন। তাকে সহযোগিতা করে সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা নামধারী কতিপয় সেনানায়ক।
প্রবাসে, পরবাসে অসহনীয় দুঃখ-দুর্দশা, একাকীত্ব, নিরাপত্তাহীনতায় দীর্ঘ সময় পার করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তার বেঁচে যাওয়া পরিবারবর্গ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য কঠিন এই সময়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক নির্মমতার নিদর্শন স্থাপন করেছে। দীর্ঘ এই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে জনমানুষের মন থেকে, মননশীলতা থেকে, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে নিরন্তর, মুছে ফেলা যায় নি। ইতিহাসের মহানায়ককে এভাবে অপশক্তি দিয়ে মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাসই তার সুরক্ষক হয়ে যায় ।
স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবার ফিরে এসেছে এই বাংলাদেশে। সবুজের শ্যামল ছায়ায়, প্রবাহমান নদীর কলকল ধ্বনিতে, কৃষাণ-কৃষাণীর সবুজ মাঠের সোনালী ফসলের আবরণে, সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দোলায়িত বাতাসে। কবিরা কবিতা লিখেছে, শিল্পীরা অন্তর দিয়ে তাদের গায়কি প্রকাশ করেছে। সাহিত্যিকরা মুজিবকেন্দ্রিক সাহিত্য রচনা করছে অবিরাম। গ্রাম-বাংলার মানুষেরা দীর্ঘশ্বাসে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুজিবকে উপলব্ধি করেছে, আকাশের নীলে তাঁকে খুঁজেছে। এভাবেই মুজিব টুংগীপাড়া থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলাদেশে। ১৭ কোটি মানুষের মন ও মননে। অতঃপর সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠ হয়ে বিশ্ব মানবতায়, বিশ্ব বন্ধুত্বে।
১৯৯৬ সালে মুজিব এসেছে প্রতিটি বাঙালির সত্তার শুদ্ধির পাহারাদার হয়ে, একুশবছর পর প্রিয় স্বদেশকে অন্ধকারের ইতিহাস থেকে মুক্ত করার জন্য। তিনি আবার আসেন অবিনাশী, অমিতায়ু আদর্শের প্রতিভূ হয়ে। তিনি আসেন নিজের অধিকারের অনিবার্য ইতিহাসের আসনে। আজ তিনি সবখানে। নেই কোনখানে? বেতারে, টিভিতে, কাগজে, ডাকটিকিটে, পাঠ্যবইয়ে, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালে, অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে, বিশ্বদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের নামে বেনারে, ফেস্টুনে। ভালো-মন্দ মানুষের মুখে মুখে। চোখ খুললেই বঙ্গবন্ধু।
শত বছর আগে যে মানুষটি জন্ম নিয়ে বাঙালি মনীষার সুগন্ধ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেই ইতিহাসের নির্মাতা হয়েছেন, ইতিহাসকে ত্যাগ তিতিক্ষা, কর্ম, শ্রম, নির্যাতন সহনীয়তা দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন, তিনি কি করে আর সাধারণ থাকেন। তাঁর সময়কে ছাড়িয়ে গিয়ে মহাকালের মহানায়কে পরিণত হয়েছেন তিনি। তিনি আজ বিশ্বের অনন্য বিস্ময়।
ছবি বা ভাস্কর্যের কি প্রাণ আছে? যদি তার পেছনে আদর্শের প্রাণ প্রতিষ্ঠা না করা যায়, তবে ভাষ্কর্য নিষ্প্রাণ। মুজিবের রাজনৈতিক আদর্শ এবং চেতনাই তাঁর ছবি ও ভাষ্কয্যের প্রাণ। আদর্শ ও চেতনা ছাড়া ভাষ্কর্য এবং কাগুজে ছবি কোন জাতিকে বা জনগোষ্ঠিকে প্রেরণা জোগাতে পারেনি, পারেনা। তাঁর এই দ্বিতীয় বারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ব্যর্থ না হওয়ার জন্য আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক কৃষকলীগ প্রত্যেক সংগঠনকে গ্রামে-গঞ্জে তাঁর আদর্শকে ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব নিতে হবে। তাঁকে তারুণ্যের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদের চেতনাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শাণিত করতে হবে।
বেশি আড়ম্বরের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজতে তাদের যে বিভ্রান্তি হবে, তার দায় কে নেবে। নিবিঢ় অসমান্তরাল আদর্শ ও কর্মে বঙ্গবন্ধুর দীপ্তি বিশ্বময়। তাঁর আদর্শ, সংগ্রাম ও কর্মসাধনার একটি আদর্শ পথমানচিত্র আছে। তা নিবিঢ়ভাবে পাঠ ও চর্চা অত্যাবশ্যক। আমাদের মনে রাখা দরকার, বাহুল্য আড়ম্বর, ছবি বা ভাষ্কর্য যেন মানুষ মুজিব, নেতা মুজিব, পিতা মুজিব বা মুজিবাদর্শকে খুঁজে নিতে প্রজন্মের মাঝে কোন দেয়াল তৈরী না করে ফেলে। আজ চারদিকে দুঃখজনকভাবে মুজিব আদর্শের বেসাতি চলছে।
ব্যবসার প্রক্রিয়া চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই সর্তকতা জারি করেছেন। তাঁর নির্দেশনা অতিশয় দূরদর্শী এবং ভ্রান্তিবিনাসী। আমাদের উচিত আদর্শিক বঙ্গবন্ধুর সুগন্ধ বিশ্বময় অপ্রতিরোধ্যভাবে, সচেতনভাবে, দায়িত্ববোধের সাথে ছড়িয়ে দেয়া। বঙ্গবন্ধুর রক্ত¯্রােতের অদম্য নেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে, সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ করে, সাংস্কৃতিকভাবে মজবুত করে, আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত করে করে স্বপ্নজয়ের যে পথে অগ্রসরমান আছে, তা এগিয়ে নিতে হবে, স্বপ্নজয় করতেই হবে।
শতবর্ষী মুজিব সে চেতনাকেই ধারণ করে। সে চেতনারই চাষ তারুণ্যের মাঝে অদম্য ভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। মুজিববর্ষের আনন্দঘন, প্রতিশ্রুতিদ্দীপ্ত, উচ্ছ্বাসপৃক্ত এই দিনে এই প্রত্যয়ই এদেশের আপামর মানুষকে শাণিত করুক, সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের মননে ছড়িয়ে পড়–ক, এ প্রত্যাশা নিরন্তর।
সকলকে মুজিব শতবর্ষের, মুজিবাদর্শের অনিঃশেষ শুভেচ্ছা। (সমাপ্ত)

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কর্ণফুলী গবেষক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট